টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় করণীয়
এম এ কাদের
সুন্দর দেশ গড়ার জন্য সুন্দর একটা সুযোগ এসেছে। নানা অশুভ, অরাজক শক্তির কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ ৫৩ বছরেও সেই সুযোগ পাওয়া যায়নি। সুন্দর দেশ গড়ার জন্য সৎ, যোগ্য প্রতিনিধি দরকার। এটার ই দেশে বড় অভাব। কারণ অযোগ্য, অসৎ লোকের দাপটে সৎ, যোগ্য প্রতিনিধি যোগ্য জায়গায় পৌছাতে পারেনা। এতকাল অযোগ্য, অসৎ প্রতিনিধিরা দেশের মানুষের সম্পদ লুট করে শত শত কোটি টাকার সম্পদ দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছে। এদিকে আমাদের খেয়াল রেখেই সৎ, যোগ্য জনপ্রতিনিধি তৈরী করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক পরিশ্রম করেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা যোগ্য জায়গায় যেতে পারেনি। একদিকে সরকারের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য বিভিন্ন কোটা পদ্ধতি চালু এমনকি, গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল, ইউনিভার্সিটি ও বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস সহ মেধাবীদের প্রতি অবহেলার ফসলই ছাত্র, জনতার এই গণবিস্ফোরণ। আগামী দিনে প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, সত্যিকার অর্থে যারা লুটপাটের উর্ধ্বে থেকে জনগণের কল্যানে কাজ করবে তারাই যাতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার বিকল্প নেই।
দেশ উন্নয়নে প্রকৃত গনতন্ত্র সরকার ব্যবস্থায় আইন, নেতৃত্ব, নীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনা, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি প্রণয়ন করতে জনগণ দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বর্তমান বিশে^ সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষিত হয়। ফলে, নাগরিকগণ গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল। তবে, বিভিন্ন দেশে এই গণতন্ত্রের স্বরূপে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়, যদিও এই সরকার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য থাকে জনগণের স্বতঃস্ফ’র্ত অংশগ্রহণ। গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরী হয়।
আমাদের দেশে কখনও প্রকৃত গণতন্ত্র ছিল না, এখনো নেই, তাই বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নিরাশা বিরাজ করছে। আমাদের দেশে বৃহৎ ৩টি দলের কাছে গণতন্ত্র একেবারেই অসহায়। বর্তমান প্রধান দুটি দলের বক্তব্য হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আসলে দুই দলই যখন ক্ষমতায় ছিল তখন কি দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ছিল? ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নূর হোসেন “ স্বৈরাচার নিপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক “ শ্লোগানে জীবন দিয়ে আন্দোলন বেগবান করেন। তার ফলশ্র“তিতে ১৯৯০ এর গণআন্দোলনে সরকারের পতনের পর ২০০৬ সালের অধিক সহিংস ঘটনা, ২০১৪ সাল, ২০১৮ সাল ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন এদেশের কোন সচেতন মানুষ বা কোন দলের কাম্য হওয়া উচিত নয়। গণতন্ত্র হত্যাকারী ৯০ সালের সরকারের পতন হবার পর আমরা কি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি? ২০০৬ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ফখরুদ্দীন-মঈন উ. আহম্মেদ কি আমাদের সঠিক গণতন্ত্র স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে পেরেছেন? এখন পর্যন্ত কোন দলের মধ্যেও কি গণতন্ত্র সঠিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? হয়ত হয়নি, আগামী কতদিনে সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে তাও বলা মুশকিল। সব কথা বলা না গেলেও দিনের আলোর মত সত্য, দেশ থেকে দূর্নীতি দূর করা না গেলে কোনদিনই সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ সকল অপকর্মের হোতা দূর্নীতি। এ বিষয় শুধু এখন নয়, অতীতে স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে এখনও পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজ করছে। মুখে সব দলই গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে ক্ষমতায় এসে তারা কর্তৃত্বপরায়ন ও দলের মধ্যে সুবিধাবাদী একটি গোষ্ঠী হয়ে উঠে। দেশে যত অনিয়ম দূর্নীতি, গণতন্ত্র হত্যাসহ অপকর্ম সংগঠিত হয় তা যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছত্রছায়ায় হয়ে থাকে, এটা সর্বজন স্বীকৃত। আমাদের দেশে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি ক্ষমতায় এসে নিকটআতœীয় এবং তার চতুর্দিকে ঘিরে থাকা লোকজন যেখানেই আয়ের সুযোগ থাকে সেখানেই হানা দিয়ে অবৈধভাবে চাঁদাবাজিসহ টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও মাসোয়ারা আদায় করে অতি সহজে শতশত কোটি টাকার মালিক বনে যায়। আমরা অনেকেই অনেক সময় বলে থাকি আগে গনতন্ত্র ছিল, ছোট-বড়র সম্মান ছিল, নেতা বা জনপ্রতিনিধি ভাল ছিলো, আসলে বিষয়টি কি সত্য? এটা আমরা কখনই বিচার বিবেচনায় আনিনি। আজ থেকে ৮০-৯০ বছর আগে জমিদারী শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হবার পর শিক্ষার হার যখন একবারেই কম ছিল, মানুষ যখন এত সচেতন ছিলনা তখনও জনপ্রতিনিধির লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। টেন্ডারবাজি, চাদাবাজি না থাকলেও জোরদারের আত্মীয়-স্বজন, সহচর এরাই সরকারী সম্পত্তি, জমিদারের জমি, রেল কোম্পানীর সম্পদ, খাল-নদী দখল, খাস জমি, চর দখল এমনকি জনগনের চলাচলের বিঘ্ন ঘটিয়ে সরকারী রাস্তার উপর দোকান-পাট বাড়িঘর তৈরী করে এখনও জোতদাররা বহাল তবিয়তে আছে।
বর্তমানে দেশে শিক্ষিতের হার ৭৩% হওয়া সত্ত্বেও এই ধারাবাহিকতা থেকে এখনও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। যারা গনতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধার নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে, গণতন্ত্র এদের কাছেই জিম্মি। গণতন্ত্র নামটি তাদেরই দখলে। ৯০ সালের পর বড় বড় কিছু ঘটনা এদশের মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। আগষ্টের গ্রেনেড হামলা, সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা, বিভিন্ন সময় গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরে সাধারন মানুষ হত্যা, জনগনের মিটিং মিছিলে হামলা, মতামত প্রকাশে বাঁধা, হত্যা, খুন, গুমসহ অহেতুক রাজনৈতিক হয়রানি এগুলো গণতন্ত্র ধ্বংসেরই নামান্তর।
দেশে প্রকৃত টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কোন দলীয় সরকারের অধীনে নয়, অবশ্যই নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এই নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের মেয়াদকাল কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। এই ১ বছরে, বিগত সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার-বিবেচনায় এনে ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত এবং অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া এই মেয়াদকালের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা পরিষদ, জেলা পরিষদসহ জাতীয় নির্বাচন গ্রহনযোগ্য ভাবে স¤পন্ন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নির্বাচিত সরকারের ৫ বছর মেয়াদকালে দুর্নীতি নির্ম’ল করার জন্য শুধু দুদক নয়, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার (ভোট পরিচালনা কমিটি) থেকে বাছাইকৃত ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি (ছায়া কমিটি) তৈরী করে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধি ও অফিস-আদালত, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, আমলাদের দুর্নীতি নজরদারিতে রেখে পরবর্তী ৫ বছর পর নির্দলীয় সরকারের আমলে দুর্নীতিগ্রস্থদেরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি ৫ বছর পর, পর এই ধারাবাহিকতা রাখতে পারলে দেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দুর্নীতি উচ্ছেদ হবে। এ সিদ্ধান্তে একমত হয়ে নির্বাচন বাস্তবায়ন করলে দেশের মানুষ বড় ধরনের সংঘাত থেকে রক্ষা পাবে। দেশে টেকসই গণতন্ত্র হলে সৎ-যোগ্য নেতৃত্ব আসবে। দলের মনোয়নের জন্য অযোগ্য অসৎ লোকদের ভিড় কমে যাবে। এতে বন্ধ হবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, মাদক, সড়ক দূর্ঘটনা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভর্তি বাণিজ্য, সোনা চোরাচালান, বিদেশে অর্থপাচার, শেয়ার কেলেংকারী, কোচিং বাণিজ্য, অফিস আদালতের হয়রানী, অযোগ্যদের যোগ্যস্থান দখল, নারী নির্যাতন, গুম-খুন-ধর্ষণের মত অপরাধ। ফলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
makader958@gmail.com
No comments