আমি আমার সন্তানদের মরতে দেখেছি’
চিত্রা নিউজ ডেস্ক-
ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে লেবানন থেকে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টার সময় নৌকাডুবিতে পুরো পরিবার হারিয়েছেন তিনি৷ ৩৭ বছর বয়সি উইসাম টেলাউয়ি জানিয়েছেন তার গল্প৷
তার পুরো পরিবার ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছে৷ উইসাম টেলাউয়ি কোনোক্রমে বেঁচে গেছেন৷ অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, ‘‘সৃষ্টিকর্তা প্রথমে আমাকে মেরে ফেলেছিলেন, পরে আবার জীবন দান করেছেন৷’’
নৌকা ডোবার পর উইসাম টেলাউয়ি দুই হাতে দুই সন্তানকে আকড়ে ধরেছিলেন৷ তারা সেই অবস্থাতেই মারা গেছে৷ তার অন্য দুই সন্তানকে স্ত্রীর কোল থেকে ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে যেতে দেখেছেন তিনি৷ একসময় স্ত্রীও পানিতে ডুবে যান৷
গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে লেবানন এবং সিরিয়ার মাঝে তাদের বহনকারী নৌকাটি ডুবে যায়৷ ভয়াবহ সেই রাতে সমুদ্রের ঢেউ টেলাউয়ি এবং প্রাণে বেঁচে যাওয়া অন্য ২০ জনকে সিরিয়ার সমুদ্রবন্দর টারটুসের উপকূলের দিকে নিয়ে যায়৷
‘‘আমার ছেলে আমার বাহুতে মারা যায়, সে অনেক দুর্বল ছিল৷ তারপর দুইদিন সাগরে ভেসেছিলাম৷ এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই৷ জ্ঞান ফেরার পর আমার মেয়েকে আর খুঁজে পাইনি৷ তাকে আমি আমার সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলাম,’’ বলেন টেলাউয়ি৷
একটি কোনোক্রমে তৈরি নৌকায় ১৫০ বা ১৬০ জনের মতো মানুষ ছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মানবপাচারকারীরা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে সেই নৌকায় উঠতে বাধ্য করেছিল৷ নৌকাটি অতিরিক্ত বোঝাই করা হচ্ছে দেখে আমি নেমে যেতে চেয়েছিলাম৷ তখন তারা আমার ছেলের দিকে বন্দুক ধরে হুমকি দেয় যে তাকে নৌকা থেকে ফেলে দেবে৷’’
সেই নৌকা ডুবে গেলে একশোর বেশি মানুষ প্রাণ হারান৷ তাদের অধিকাংশই লেবানন, ফিলিস্তিন এবং সিরীয় পরিবার৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার চরম অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং লেবাননে চলমান সংকট থেকে বাঁচতে তারা ইউরোপমুখী হয়েছিলেন৷
লেবানন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ
উইসাম টেলাউয়ির বাড়ি লেবাননের উত্তরাঞ্চলে৷ সিরিয়া থেকে কয়েকসপ্তাহ আগে সেখানে চলে যান তিনি৷ এখন অবশ্য ত্রিপোলিতে ময়লা সংগ্রহের চাকুরিতে ফিরে গেছেন টেলাউয়ি৷
তিনি নৌকা ডুবির ঘটনার জন্য মানবপাচারকারীদের পাশাপাশি লেবাননের সেনা এবং নৌবাহিনীর সদস্যদেরও দায়ী করেছেন৷
স্থানীয় একজন বিশেষজ্ঞ আমাদের জানিয়েছেন যে শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে লেবাননের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বেড়ে গেছে৷
‘‘স্থানীয় মুদ্রায় পাওয়া বেতন দিয়ে লেবাননের একজন কর্মকর্তা কোনোমতে পরিবহণের খরচ মেটাতে পারেন,’’ বলেন আইনজীবী মুহাম্মদ সাবলু৷ নৌকা ডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া টেলাউয়ি এবং অন্যান্যদের পক্ষে মামলা লড়ছেন তিনি৷
লেবানন কর্তৃপক্ষ অবশ্য দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷
লেবাননের উত্তরাঞ্চল থেকে অভিবাসন বাড়ছে
লেবাননের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নৌকায় করে অনিয়মিত পথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টার কথা গত দশবছর ধরে শোনা যাচ্ছে৷ এবং এই প্রবণতা গত দুই বছরে বেশ বেড়েছে৷
আর এর কারণ শুধু অর্থনৈতিক সংকট নয়, ইউরোপীয় দেশগুলোর ভিসা দেয়ারক্ষেত্রে ক্রমশ বেড়ে চলা বিধিনিষেধ এবং সিরীয় ও লেবাননের কর্তৃপক্ষের নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের পাসপোর্ট দিতে গড়িমসিও এক কারণ৷
ত্রিপোলিতে অবস্থানরত গবেষক ওবেইদা তিকরিতি এই বিষয়ে বলেন, ‘‘এমন নয় যে একবারে দরিদ্ররা দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন৷ কারণ মানবপাচারকারীদের দেয়ার মতো টাকা তাদের কাছে নেই৷ তারাই দেশ ছাড়তে চাচ্ছেন যারা আর আশাবাদী নন এবং তাদের কিছু সঞ্চয় আছে বা বিদেশে থাকা আত্মীয়রা তাদের আর্থিক সহায়তা করছেন৷’’
উত্তর লেবাননের উপকূল থেকে ইউরোপের দিকে যাত্রা করতে মানবপাচারকারীদেরকে জনপ্রতি ছয় লাখ টাকা দিতে হয়৷
‘‘আমি প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছি,’’ বলেন টেলাউয়ি৷ তিনি তার বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা যোগাড় করেছিলেন৷ এত টাকা খরচ করে অনিয়মিত পথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে পুরো পরিবার হারিয়েছেন তিনি৷
প্রকাশিত : 12/12/2022
প্রতিবেদন ইনফোমাইগ্রেন্টস ডেস্ক লেবানন
No comments