হাজারো সমস্যায় কোটচাঁদপুরের কেন্দ্রিয় হ্যাচারীটি, রেনু ও পোনা উৎপাদন করে মাছচাষে বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে

চিত্রা নিউজ ডেস্ক-

নেই পর্যাপ্ত জনবল, বসার মতো কোনো ভালো অফিসও নেই। পুকুরগুলোও সংষ্কার করা হয়নি দীর্ঘদিন। পুকুর পাড়ের সড়ক বাতিও জ্বলে না। এরপরও অত্রাঞ্চলের ৬০ শতাংশ মাছের রেনু ও পোনার চাহিদা পুরণ করে চলেছে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের কেন্দ্রিয় হ্যাচারী ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুরের বলুহর হ্যাচারীটি। এই হ্যাচারীতে উৎপাদিত নানা জাতের পোনা মাছ অত্রাঞ্চলে মাছ চাষের বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। তারা প্রায় ৫০ লাখ টাকা মুল্যের রেনু ও পোনা উৎপাদন করছে বছরে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। 

হ্যাপারী কর্তৃপক্ষ বলছে সরকারের পৃষ্টপোষকতা পেলে তারা ব্যক্তি পর্যায়ে মাছ চাষে আরো বেশি ভুমিকা রাখতে পারবে। ইতিমধ্যে তারা চীন ও ভিয়েতনাম থেকে রেনু আমদানি করে মাছ চাষ এলাকায় ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তারা নতুন নতুন জাতের মাছের রেনু ও পোনা দিয়ে এলাকায় মাছ চাষ বৃদ্ধি করে চলেছে।

সরেজমিনে হ্যাচারী ঘুরে জানাযায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মৎস্যজীবী, মৎস্য হ্যাচারী, ব্যক্তি পর্যায়ে মৎস্য চাষিদের মধ্যে কার্পজাতীয় মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯৮৪ সালে কোটচাঁদপুর উপজেলার বলুহর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশের বৃহত্তম মৎস্য হ্যাচারী কমপ্লেক্সটি। ১০৩ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত এই হ্যাচারীতে রয়েছে ৩০ টি পুকুর। যেখানে নিয়মিত মাছের রেনু ও পোনা তৈরী করা হচ্ছে। যা মৎস্য চাষী ও হ্যাচারী মালিকদের নিকট সুলভ মুল্যে বিক্রি করছে। 

হ্যাচারীর এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছিল। হ্যাচারীর ভবনগুলো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়তো। পুকুরগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার যাচ্ছিল না। ২০২০ সাল থেকে হ্যাচারীটি আবার ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হয়েছে। হ্যাচারীর ব্যবস্থাপক মোঃ আশরাফ-উল-ইসলাম যোগদানের পর প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে এগিয়ে চলেছে। খুলনা বিভাগের ১০ টি জেলায় তারা নিয়মিত রেনু, পোনা ও ব্রুড সরবরাহ করছে। প্রযুক্তি হস্তান্তরও সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় এলাকায় কার্প হ্যাচারী ও নার্সারী শিল্পের প্রসার ঘটেছে। শুধুমাত্র যশোর ও ঝিনাইদহ জেলায় ২’শ অধিক কার্প হ্যাচারী ও ৩৫’শ অধিক নার্সারী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে হ্যাচারীতে সরকার নিদ্ধারিত লক্ষ্যমাত্র অর্জনে সক্ষম। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৪৮ লাখ ১১ হাজার টাকা বিক্রির লক্ষ্যমাত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে অর্জন হয়েছে ৪৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। 

হ্যাচারী কর্মকর্তারা জানান, এই হ্যাচারীতে বর্তমানে ২৭ টি পদের মধ্যে ১০ টি পদে লোকবল রয়েছে, ১৭ টি পদ শুন্য। ৭ জন দক্ষ ফিসারম্যান থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ২ জন। ৪ জন পাম্প অপারেটরের স্থানে আছে ১ জন। এভাবে ১৭ টি শুন্য পদ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। 

এক কর্মচারি জানান, এতো প্রতিকুলতার মধ্যেও বিগত ৩৬ বছরে সরকারের নিদ্ধারিত লক্ষ্যমাত্র অর্জন করেছে। করোনা কালেও রেনু ও পোনা উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল। তাছাড়া ঝিনাইদহ , যশোর জেলা বাওড় সমৃদ্ধ হওয়ায় এখান থেকে তৈরীকৃত রেনু ও পোনা বাওড়ে মজুত ও চাষের ফলে শত শত টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। ওই কর্মচারি আরো জানান, চীন থেকে আমদানিকৃত বিশুদ্ধ প্রজাতির সিলভার, বেগহিড ও গ্লাসকার্পের পোনা ২ বছর পরিচর্চার পর ব্রুড উৎপাদন সম্পন্ন শেষে সেইব্রুড থেকে রেনু উৎপাদন করছে তারা। যা ইতিমধ্যে বিক্রি শুরু হয়েছে। এই ব্রুডের গুনগতমান নিশ্চিত করতে বিএফআরআই থেকে সুবর্ণ রুই, পাঙ্গাশ ও কালিবাউশ মাছের ব্রুড উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছেন।

হ্যাচারীতে ঘুরতে আসা কালীগঞ্জের আতিকুল ইসলাম জানান, হ্যাচারীটি একটি দর্শনীয় স্থান। এখানে অনেকে বনভোজন করতে আসেন। তিনিও মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসেন। তিনি বলেন, প্রায় ১৫ বছর পড়েছিল হ্যাচারীর প্রশাসনিক ভবন। আবর্জনার স্তুপ ছিল চারপাশ। সেগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে অতিসম্প্রতি। পাশে করা হয়েছে ফুলবাগান। মাছ চাষের পাশাপাশি হ্যাচারীটি দর্শনীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। এখন তারা নিয়মিত আসেন। মৎস্যচাষী সজিব আহম্মেদ জানান, তারা নিয়মিত এখান থেকে রেনু ও পোনা নিয়ে থাকেন। এখানে সব সময় সল্পমুল্যে রেনু ও পোনা পাওয়াযায়। যা তাদের মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করে। তার মতো অনেকে এখান থেকে রেনু ও পোনা নিয়ে মাছ চাষ করে আজ স্বাবলম্বি হয়েছেন। 

হ্যাচারী ব্যবস্থাপক মোঃ আশরাফ-উল ইসলাম জানান, বলুহর কেন্দ্রিয় হ্যাচারী একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এখানে রেনু ও পোনা উৎপাদন করে মৎস্য চাষীদের মাঝে সুলভ মুল্যে বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি মাছ চাষে নতুন নতুন কলাকৌশল ও প্রযুক্তি সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির কিছু সমস্য রয়েছে যা সমাধান জরুরী। তিনি বলেন, ১ নম্বর গেট থেকে বাওড় গেট পর্যন্ত প্রাচীর নির্মান, রেনু উৎপাদন কাজে পানি সরবরাহের জন্য ৯ ইঞ্চি সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন, ১৫ টি পুকুর পুর্ণঃখনন, পুকুর পাড়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা, স্টোর রুম সংষ্কার সহ বেশকিছু কাজ জরুরী। তাহলে হ্যাচারীটি আরো বেশি বেশি রেনু ও পোনা উৎপাদন করে অত্র এলাকার মাছ চাষে ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে। 

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আলফাজ উদ্দিন শেখ জানান, দক্ষিন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্যাচারী এটি। এখানে দেশি-বিদেশি পোনা উৎপাদন হচ্ছে। হ্যাচারীতে কিছু সমস্য রয়েছে, যা তারা সমাধানের চেষ্টা করছেন। 


No comments

Powered by Blogger.