আলোর ভেতর যত কালো

এম এ কবীর

সাংবাদিক-

শেক্সপিয়ারের নাটককের সৃষ্ট চরিত্রগুলো অমলিন। তাঁর কলমের ছোঁয়ায় প্রাণ পাওয়া চরিত্রগুলো ঘটনা-দুর্ঘটনায় মিলেমিশে আছে এখনো। শেক্সপিয়ারের সেরা  চারটি ট্র্যাজেডির একটির নাম ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথ নায়ক নাকি খলনায়ক, সেটা বলা সম্ভব নয়। ওথেলোয় যেমন একজন ইয়াগোর প্ররোচনা রয়েছে, তেমনি ম্যাকবেথকে কুকর্মে ইন্ধন দেয়ার জন্য ছিলেন লেডি ম্যাকবেথ। রাজা ডানকানকে হত্যার পর আরব্যজগতের সব সুগন্ধি দিয়েও নিজের হাত থেকে রক্তের দাগ মুছতে পারছিলেন না তিনি। টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রদীপকে ২০ বছর এবং তাঁর স্ত্রী চুমকি কারনকে ২১ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতির এই মামলার রায়ে বলা হয়, স্বামী যতটা ক্ষমতাবান, স্ত্রীও লোভের দিক থেকে ততটাই বে-পরোয়া। ম্যাকবেথ, লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে পার্থক্য ছিল। লেডি ম্যাকবেথের মধ্যে মানবতার লেশমাত্র ছিল না। লেডি ম্যাকবেথ  প্রয়োজনে দুধের শিশুকে দুধের বোঁটা ছাড়িয়ে তাঁর মগজ গুঁড়িয়ে দিতে পারেন। এই দম্পতিও তার চেয়ে কোনো অংশে কম যান না। দুর্নীতির খবর প্রচারিত হওয়ার আগপর্যন্ত  এই লেডি ম্যাকবেথরা আড়ালেই থেকে যান।  

সঙ্গী ছাড়া জীবন হয়তো চলতে পারে। কিন্তু তা-কি উপভোগ করা যায়। জীবনের তাগিদে তাই জীবনসঙ্গী বেছে নেয় মানুষ। সেই বেছে নেয়ার প্রক্রিয়া কখনো ছাড়িয়ে যায় ভৌগলিক সীমানা, কখনো ভেঙে দেয় বয়সের বাধা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই চলে সঙ্গী নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। সম্প্রতি আলোচনায় রয়েছে, কলেজ শিক্ষিকার সঙ্গে ছাত্রের বিয়ে। মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা  অপূর্ব। মায়ের সঙ্গে মানানসই পাত্র চান। বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে মা-ছেলে ও মায়ের একার ছবি যুক্ত করা হয়েছে।

 সমাজের কোনো কোনো অংশের সদস্যরা এখনো সাবালক হননি। আমাদের যাপিত জীবনের সমাজ ঠিক পত্রিকার পাতার মতো নয়। সামাজিক জীবনে আধুনিক কালের সামাজিক চুক্তিভিত্তিক কার্যকলাপের প্রতিফলন কম। চুক্তি-পূর্ব অবস্থার মতো এদেশের মানুষের আচার-আচরণ স্বাধীনতার পর চুক্তি-উত্তর সমাজের রূপান্তরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে সামাজিক চুক্তির আলোচনা ব্যাপক পরিসরে বাড়িয়ে তোলা দরকার। শিক্ষার গুণগত ঘাটতি এক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ভালোবাসা থেকেই স¤পর্কের উৎপত্তি। ঘৃণা থেকেও স¤পর্ক হয় তবে পরিণতি কী হয় তা সময় বলে দেয়। কিছু স¤পর্ক হয় একেবারেই অসম,অসম্ভব। পাপের সম্পর্কও আছে। আছে সম্পর্কহীন হয়ে আবার সম্পর্কে জড়ানোর গল্প। সম্পর্ক মানেই একটি চেইন, পরিবার ও পরিবার থেকে সমাজ। এখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বাইরে একজন শিক্ষক আমাদের কাছে যে অবয়ব, তাকে সম্মানের দৃষ্টিতে আমরা কখন দেখি? যখন শিক্ষক মানে আমরা বুঝে নিই তিনি আমাদের দিক নির্দেশক, আদর্শিক একটা পাথেয়। ঠিক তেমনি সামাজিক আচারে আরো অনেক স¤পর্ক রয়েছে। প্রতিটি সম্পর্কের একটা মাত্রা রয়েছে, ভাষা রয়েছে, ভাষার পার্থক্য রয়েছে, বোধের একটা পরিশীলন রয়েছে। সব মিলে আমরা সম্পর্কে এক ধরনের স্পন্দন বলতে পারি। যে সম্পর্কে কোনো রক্তের আবেশ না থাকে এবং যে সম্পর্ক নর-নারীকে এক জায়গায় রাখতে বাধ্য করে এ সম্পর্কগুলো অদৃশ্য আবেশে অন্তর্ভূক্ত। 

সমাজে এখন যে বিষয়গুলো ঘটছে তা সুস্থ সমাজের পরিচায়ক নয়। কারণ না খুঁজে সম্পর্কের হুলোস্থুলে আমরা যে আমাদের নিজেদের সম্মানের জায়গা, নিজেদের স্বকীয়তার জায়গা, বিবেচনার জায়গা হারাচ্ছি তা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। তথ্যের অবাধ ব্যবহারে অন্য দেশের মানুষেরা স¤পর্কের টানে আমাদের এখানে চলে আসছেন। আমরা আনন্দিত হচ্ছি। কিন্তু  এই চলে আসা, সম্পর্ক স্থাপন, এই ভালোলাগা কতটুকু মোহ এবং কতটুকু সত্যি তা বিবেচনার জন্য সময় না নিয়েই বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করে তোলা হয়। 

গত কিছুদিনে অনেকগুলো মানুষ তথাকথিত  প্রেমের টানে আমাদের দেশে এসেছেন। যে যে দেশ থেকে তারা এসেছেন সেখানে তাদের অবস্থান, পেশা, যোগ্যতা এবং তাদের উদ্দেশ্য কী তা আমাদের জানা কি দরকার ছিলো না? আন্তর্জাতিক কোনো চক্রের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা সে বিষয়গুলোওতো দেখা দরকার। এবার আসা যাক কিশোর কিশোরীদের সরল প্রেমে। ডিজটালাইজেশনে দেখা হয় ফোনে, কথা হয় এয়ার ফোনে, চুক্তি ভার্চুয়ালে আর বিয়ে করে হুমড়ি খেয়ে। ফলাফল ছাড়াছাড়ি, আত্মহত্যা নতুবা হতাশ জীবন নিয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে জীবন পার করা। 

অনেক স্কুলে বিশেষ করে কিন্ডার গার্টেনগুলোতে শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী হয়রানি এখন তুঙ্গে। পড়াশোনা না পারলে, প্রাইভেট না পড়লে ছাত্রীদের হয়রানি করে শিক্ষকরাই। এমনও  শিক্ষক আছেন যারা ছাত্রীদের ছবি অন্য ছাত্র দিয়ে তুলে ছাত্রীকে এই ছবি প্রকাশ করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করতে চান। সম্পর্কের যে স্তর বিন্যাস নিয়ে কথা, সেখানে একজন শিক্ষক ও ছাত্র’র  প্রেম ও বিয়ে নিয়ে একটি সংবাদ ফেসবুকে ঘুরছে। অনেকেই অভিবাদন জানিয়েছেন। প্রেম ও ভালোবাসা জৈবিক কিন্তু অপরাধ কখন হয়? যখন একজন আরেকজনের অমতে তার ওপর ব্যভিচার করতে চায় তখন। যদি এ ধরনের কাজ অপরাধ হয় তবে সামাজিক বন্ধনের একটা চলে আসা নিয়ম ভাঙার ফলে যদি অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তবে তাকি অপরাধ নয়? শিক্ষকরা আগে তেমন একটা টিজের শিকার হতেন না। ছাত্র এবং শিক্ষিকার এমন স¤পর্ক যখন বার বার টিভি স্ক্রিনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসে তখন এ থেকে যদি আরো অনেকেই উৎসাহিত হয়, কোনো শিক্ষিকা যদি ছাত্রের দ্বারা কোনো ধরনের টিজের শিকার হন তবে সম্পর্কের স্তর বিন্যাস আবারও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সম্পর্ক শ্রদ্ধারও একটি রূপ। আমরা যেমন সব নারীকেই একভাবে ভাবতে পারিনা তেমনি সব নারী একজন পুরুষকেও একভাবে ভাবতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা স¤পর্কের মাপ বোঝানোর জন্যই আমাদের বিভিন্ন স¤পর্কে পৃথিবীতে আবির্ভূত করেছেন। 

প্রকৃতিও সম্পর্ক মেপে মেপে স্থাপন করে। যে বৃক্ষ মাটিতে হয় তাকি পানিতে বপন করলে বাঁচে? মাছ যদি মধ্য স্তরের খাবার খায় সে মাছকে সাগরে নিয়ে দিলে সে’কি টিকতে করতে পারে? সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার একটা সময় এসেছে। আমাদের সন্তানেরা এগুলো দেখে দেখে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যেতে পারে। তারা উৎসাহিত হবে ভিন্ন ধরণের সম্পর্কে জড়াতে। সামাজিক বিশৃংখলার প্রধান দায় যদি স¤পর্ক স্থাপনের ওপর গিয়ে পড়ে তখন কিন্তু আমরা আর নিজেদের যে একটা অসাধারণ সুন্দর শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্কের জায়গা আছে সেখানে ফিরতে পারবো না। ছাত্র আর শিক্ষিকার যে বিয়ে নিয়ে এত তোলপাড় এর চেয়ে ভালো সংবাদ হতে পারে কারা তাদের পারিবারিক জীবনে সুখী ও স্বার্থক, পাশাপাশি সংসারের বাইরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজেরা সচেষ্ট। 

নাট্যকার নাটকের জন্য স্ক্রিপ্ট  লেখেন। প্রবন্ধকার প্রবন্ধ লেখেন। কবি কবিতা লেখেন। উপন্যাস লেখাহয়। গল্প, ভ্রমণকাহিনী, জীবনীগ্রন্থ, আত্মজীবনী, গান, কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্রের জন্য স্ক্রিপ্টও লেখা হয়। অনেকে প্রেম বিষয়ক, বিরহ ,নৈতিকতার অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি বিষয়ে লিখে চলেছেন। সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়েও লেখালেখি হয়। কেউ মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য কিংবা অনিয়মের বিরুদ্ধে লেখেন। সমাজ, সংসার, পরিজন, প্রতিবেশী এমনকি বিশ^ দুনিয়া পরিবর্তন করা এতটা সহজ নয়। বিবেকবোধ,চিন্তা-ভাবনা আগে পরিবর্তন জরুরি। ভেতরের অমানুষিক বোধ নিঙড়ানো দরকার। জীবনের জন্য আলো, আলোর ভেতর এত কালো অন্ধকার লুকিয়ে, সেটা দেখতে হলে কাচের চশমায় দেখা অসম্ভব।

জগতে অন্ধরা বেশি দেখে, বোবা কানে বেশি শোনে। কথাগুলো অনাদিকাল থেকে সত্য, এখনো সত্য,অতীতেও সত্য, ভবিষ্যতেও সত্য । হৃদয়চোখ এবং শ্রবণেন্দ্রিয় তাদের এতটাই স্বচ্ছ, সুন্দর যেটা অকপটে স্বীকার করাও বাঞ্ছনীয়। কারণ যারা অন্ধ নয় তারা ভালো দেখে না, যারা শুনতে পারে ভালো তারা আসলে এতটা শোনে না। আমরা সবাই বুঝি কিন্তু অবুঝ। আমরা সবাই দেখি কিন্তু নিশ্চুপ। অবুঝ আর নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে যা হবার তাতো হবেই। এটা অপ্রত্যাশিত বলাও সমীচীন নয়। যতই সালিশ করা হোক তালগাছটা আমার। মানুষ মানুষের জন্য। অনেকে উপকারে আসে অনেকে উপকারে আসে না। তারা ক্ষতির চিন্তায় মশগুল। স্বার্থের বেড়াজালে আটকা।   

 এখন গণমাধ্যমে চোখ রাখা যায় না। ঝলসে যায়। অনিয়মে, ধর্ষণে, দুর্ঘটনায়, ক্ষমতার অপব্যবহারে, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার মোহনীয় অবক্ষয়ের ছলচাতুরীয় বাহানায়। স্বজনের হাতে স্বজনের খুনের খবরে, অপ্রাসঙ্গিক সংবাদে আমজনতার বমি হয়। লেখকদের লেখালেখি বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা, পর্যালোচনা, গবেষণা, চিন্তাভাবনা কাগজেই লেপ্টে থাকে। তার কতটুকু মূল্যায়ন হয়, জনগণের কাজে আসে কে জানে। 

পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্র তথা মহাবিশে^ সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়নে লেখকদেরও  তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তবে কলমে শেকলের বেড়ি পরানোর কারণে বাকস্বাধীনতার হৃতসর্বস্ব হরণ করা হয় বিশ্বসংসারে। গণমাধ্যমসহ গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বকে, লেখক, সম্পাদক.সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক এবং নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত নয় এমন রাজনীতিকদেরও। আমরা নষ্ট সময়ের পিঠে চড়ে ছুটে চলেছি অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। 

  ২০১৭-২০২২ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত গণপরিবহন, অন্যান্য বাহন, বাসস্ট্যান্ড ও  ট্রেন স্টেশনে চার হাজার ৬০১ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৫৭ জন ও খুন হয়েছেন ২৭ জন। ৮ আগস্ট সেভ দ্য রোডের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। সেভ দ্য রোড’র মহাসচিব শান্তা ফারজানা বলেন, ৩১টি জাতীয় দৈনিক, বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত তথ্য এবং বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সক্রিয় সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকদের তথ্যে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাসস্ট্যান্ডগুলো স্বাস্থ্য সম্মত ও নিরাপদ না হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির কুরুচিপূর্ণ মানুষ নারীদের পোশাক ও চলাফেরা নিয়ে যেমন বিভিন্নভাবে কটূক্তি করে, তেমনি নির্যাতন-নিপীড়ন করতেও পিছপা হয় না। পিছিয়ে নেই ট্রেন, লঞ্চঘাট বা বিমান বন্দরও। বোরকা পরিহিত নারীরাই সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন বলে সেভ দ্য রোডের জরিপে দেখা যায়। শান্তা ফারজানা বলেন, প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে নিপীড়নের শিকার হন ৯৯ জন। তাদের মধ্যে বোরকা বা হিজাব পরিহিত নারীর সংখ্যা ৬৭ এবং অন্যান্য পোশাক পরিহিত নারীর সংখ্যা ৩২। এর নেপথ্য কারণ পুরুষদের হীন মানসিকতা, লেবাসধারী হলেও ধর্মীয় অনুশাসন না মানা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এর জন্য দায়ী।

সম্পর্কের ব্যপ্তি, সম্পর্কের টান,  সম্পর্কের স্তর বিন্যাস ও সম্পর্কের মাত্রা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে না পারা আমাদের জন্য বড় ব্যর্থতার। সব সম্পর্ক বাঁচুক সুন্দরের আত্মীকরণে। যে কোনো উপকরণই সংবাদ হয়ে ওঠার যোগ্য নয় কারণ সব উপাদানে শিক্ষার সাথে বোধের সংমিশ্রণ থাকে না। 


No comments

Powered by Blogger.