গড়াই নদী কেড়ে নিয়েছে ৪০ পরিবারের ভীটাবাড়ি আর চাষের জমি, সব হারিয়ে কেউ হয়েছেন যাযাবর কেউ আছেন অন্যের জমিতে, সেটাও নতুন করে ভাঙ্গনের মুখে
স্টাফ রিপোর্টার-
আব্দুল মালেক মন্ডলের টিনের চৌরি ঘর ছিল, মাঠে ১০ বিঘা চাষের জমিও ছিল। এগুলো এখন তার কাছে শুধুই স্বপ্ন। ভীটাবাড়ি আর চাষের জমি সবই চলে গেছে গড়াই নদীর তলে। এখন থাকেন অন্যের জমিতে। একেকবার ঘর ভেঙ্গেছে, আর বাঁচার জন্য নতুন করে ঘর বেঁধেছেন। সাতবার বসতবাড়ির জায়গা পরিবর্তনের পর বর্তমান জাগয়াটিও রয়েছে ভেঙ্গে পড়ার ঝুকিতে।
আব্দুর রহিম মন্ডল বসতবাড়ির জায়গা পাল্টেছেন ৬ বার। তারও ৮ বিঘা জমি ছিল। পাঁকা পোতার টিনের চৌরি ঘর ছিল। বাড়িতে গরু-ছাগল ছিল। যা হারিয়ে এখন অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। তারও সবকিছু চলে গেছে এই গড়াই নদীতেই। আবারো ভাঙ্গনের মুখেই আছেন ৬ জনের এই পরিবারটি।
এই অবস্থা ঝিনাইদহ শৈলকুপা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের উত্তরপাড়ার। যে পাড়াতে ৪০ টি পরিবার বসবাস করতেন, এখন আছেন ৫ টি। বাকিরা নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অনেকে ভিটাবাড়ি হারিয়ে যাবাবরের মতো জীবন কাটাচ্ছেন। যারা এখনও আছেন তারাও নদী ভাঙ্গনের ঝুকিতে। বর্তমানে নতুন করে ঝুকির মধ্যে পড়েছেন মাঝের পাড়ায় বাসিন্দারাও। নদী ক্রমেই তাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে সারুটিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে গড়াই নদী। এই নদীর দক্ষিনপাড়ে কৃষ্ণনগর গ্রাম, আর উত্তরে বড়–রিয়া। কৃষ্ণনগর গ্রামের উত্তারপাড়া এলাকায় ৫ টি পরিবার রয়েছে। তারা সবাই নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পেতে নতুন করে গ্রামের রাস্তার পাশে বাড়ি তৈরী করেছেন। সবাই টিন দিয়ে সাময়িক বসবাসের যোগ্য বাড়ি তৈরী করে আছেন। মাটির রাস্তার উত্তরের পড়ে থাকা ভিটাগুলোর বেশিরভাগ অংশ নদীতে চলে গেছে। বাকি কিছু জায়গা এখনও আছে। যেখানে উঠান, টিউবওয়েল, বাথরুম এখনও রয়েছে। বড় বড় গাছগুলো নদীর মধ্যে চলে গেছে।
কৃষ্ণনগর গ্রামের আবু তালেব জানান, গড়াই নদীটি বর্তমান স্থানের অনেকটা উত্তরে বড়–রিয়া মৌজায় ছিল। কালক্রমে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দক্ষিনে কৃষ্ণনগর গ্রামের মাঝে চলে এসেছে। তাদের বসতবাড়িও ইতিপূর্বে বড়–রিয়ায় ছিল। এখন সেখানে চর জেগেছে। তিনি জানান, নদীর দক্ষিনে ছিল তাদের বসবাস। তারা ঝিনাইদহ জেলার বাসিন্দা। কিছু দিন পর পর নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েন তারা। তাদের বাড়িঘর পানির নিচে চলে গেছে, তারা বাঁচার জন্য আরো দক্ষিনে সরে বড়ুরিয়া ছেড়ে কৃষ্ণনগর গ্রামে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন। এখন সেই কৃষ্ণনগর গ্রামটিও ভেঙ্গে নদীর তলে বিলিন হতে চলেছে। ইতিমধ্যে তাদের উত্তরপাড়াটি পানির নিচে চলে গেছে।
আবু তালেব জানান, এই উত্তরপাড়ায় বসবাস করতেন আইন উদ্দিন, আলিম উদ্দিন, আব্দুল হাকিম, জোয়াদ আলী, আবু কালাম মন্ডল, সিরাজ উদ্দিন, উজ্জল আলী, আল্লাল উদ্দিন, রবিউল ইসলাম, আবু সাঈদ, শহিদুল ইসলাম সহ প্রায় ৪০ টি পরিবার। যাদের মধ্যে এখন আব্দুল মালেক, আব্দুর রহিম, আবু তালেব, আশরাফুল ইসলাম ও হাসান আলীর পরিবার রয়েছে। বাকিরা নদী গর্ভে সব হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। কেউ কেউ অন্যত্র জমি কিনে ঘর করেছেন। আবার অনেকে সব হারিয়ে যাযাবরের মতো বসবাস করছেন।
আব্দুল মালেক জানান, তাদের পূর্বে যে স্থানে বাড়ি ছিল সেখানে এখন চর। এই চরে কুষ্টিয়ার কিছু ভুমিহীন বসবাস করছেন। চরে তাদের জমি ছিল, যা নদীর উত্তরে কুষ্টিয়া জেলার সঙ্গে হওয়ায় কুষ্টিয়ার লোকজন বাস করছেন। তারা একবার সেখানে ঘর করেছিলেন, কিন্তু পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন তাদের কিছুই নেই। আব্দুল মালেক জানান, ৮ জনের সংসার তার। নিজের বলতে এখন আর কিছুই নেই। নদীর পাড়ে জনৈক ছানার উদ্দিনের জমিতে ঘর করে ছিলেন। সেই ভিটারও কিছু অংশ এবছর ভাঙ্গনে চলে গেছে। ভয়ে সেই ভিটা ছেড়ে জনৈক মাসুদ মন্ডলের জমিতে ঘর করেছেন। তিনি বলেন, এবছর যে পরিমানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে তাতে যে স্থানে আছেন সেখানেও থাকতে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কিছুই করার নেই। রাতে ঘুমানোর পর মাঝে মধ্যেই ভয়ে জে¦গে ওঠেন। ঘরের বাইরে দেখেন সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। তিনি জানান, এ পর্যন্ত ৭ বার বসতবাড়ির জায়গা পরিবর্তন করেছেন। সর্বশেষ যে স্থান থেকে সরে এসেছেন সেখানে এক রাতে ঘরের খুটির নিচে থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। ভয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাকি রাতটুকু রাস্তায় বসে ছিলেন।
মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, তাদের মসজিদটি ছিল কৃষ্ণনগর গ্রামের মাঝে। এখন চলে গেছে নদীর পাড়ে। মসজিদটিও ভেঙ্গে পড়ার আশংকায়। তিনি আরো জানান, উত্তরপাড়া শেষ হয়ে গেছে, এবার মাঝেরপাড়া নদী গর্ভে চলে যাবে। এখনই স্থায়ী বাঁধ না দিলে একটি সময় গোটা গ্রামই বিলিন হবে।
এ ব্যাপারে সারুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক জানান, কৃষ্ণনগর গ্রামের মানুষগুলো বাঁচাতে হলে এখনই স্থায়ী বাঁধ প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তিনি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। আর উপজেলা সহকারী ভুমি কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম শীল জানান, বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখেন। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের শৈলকুপা শাখা কর্মকর্তা বিকর্ণ দাস জানান, ঝিনাইদহ অংশে ২০ কিলোমিটার গড়াই নদী রয়েছে। গত বর্ষা মৌসুমে বড়–রিয়া এলাকায় কিছু কাজ করিয়েছেন তারা। এছাড়া নদী পাড়ের মানুষগুলো রক্ষায় বড়–রিয়া, কৃষ্ণনগর ও লাঙ্গলবাঁধ এলাকার ২৩৫ কোটি টাকার ৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মান কাজের একটা প্রাক্কলন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এটা অনুমোদন পেলে তারা দ্রতই কাজ শুরু করবেন বলে জানান।
No comments