ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে যাক সবার প্রাণে-মনে

 

এম কবীর সাংবাদিক-

 দীর্ঘ এক মাসের সংযম সাধনার শেষে আনন্দময় উৎসব ঈদুল ফিতর সমাগত। সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে বুকে জড়ানোর দিন; সাম্য, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, মিলনের দিন।

পবিত্র রমজান মিতাচার অনুশীলনের যে সুযোগ নিয়ে আসে, তার তুলনা হয় না। রোজা শুধু ইন্দ্রিয়ের কৃচ্ছ্রসাধনা নয়, আত্মিক বিশুদ্ধতা অর্জনেরও পথ দেখিয়ে দেয়। এক মাসের রোজার অবসানে তাই ঈদুল ফিতরের উৎসব কেবল ভোজনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়তৃপ্তির উৎসব নয়, বিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে জীবনকে নতুন করে সাজানোর অঙ্গীকারেরও উৎসব। আত্মিক পরিশুদ্ধির ফলে দূর হয়ে যাবে সব সংকীর্ণতা ভেদাভেদ। পুরো রমজান মাস আমরা যে সংযমের অনুশীলন করেছি, তা আমাদের জীবন চলার সব ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনের নেতিবাচক প্রবণতা থেকে রক্ষা করবেএমনই প্রত্যাশা। অন্যায়, অবিচার, ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানিমানুষের সব নেতিবাচক প্রবণতার রাশ টেনে ধরবে। ঈদ যে আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছে, তার মর্মমূলে আছে শান্তি ভালোবাসা। পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক মহান উপলক্ষ ঈদ। ঈদুল ফিতরের আগমনী সুরে বেজে চলেছে মানুষে মানুষে মিলনের এই আকুতি।

মানুষে মানুষে মিলনের উৎসব যখন আসে, তখন আমাদের এটাও ভাবতে হয় যে আমাদের দেশে সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকটতর হচ্ছে। এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে বিপুলসংখ্যক মানুষ। খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্ত। এমন বৈষম্য ঈদ উৎসবের সর্বজনীনতা  ক্ষুন্ন করে।

 ঈদুল ফিতরের দিনটি অশেষ তাৎপর্য মহিমায় অনন্য। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয়, তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র রেডিও-টেলিভিশন পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্তা—‘ঈদ মোবারক সেই সঙ্গে চারদিকে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রোজার ঈদের গান: মন্ রমজানের রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্।/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্ আস্মানী তাগিদ্/...’

ঈদ মানেই আনন্দ খুশির উৎসব।ঈদ শব্দটি আরবি, শব্দমূল  ‘ আউদ, এর অর্থ এমন উৎসব, যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়, রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভৃতি। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। ঈদ প্রতিবছর চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়মকানুন পালনের পর উদযাপিত হয় ঈদুল ফিতর; অন্য কথায় রোজার ঈদ।    ‘ফিতর শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে বিজয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব উদ্যাপন করা হয়, তা- ঈদুল ফিতরের উৎসব। বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহূত গোটা রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহভীরু মানুষ তাঁর ভেতরের সব রকমের বদভ্যাস খেয়ালখুশিকে দমন করার মাধ্যমে একরকমের বিজয় অর্জন করেন। সেই অর্থে এটি বিজয় হিসেবেও দেখা যায়। সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরকে বিজয় উৎসব বলা যেতে পারে। ঈদুল ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া এদিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয়বার্তা। তবে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণীয় করার নাম ঈদ উৎসব।  ‘ঈদুল ফিতর শব্দ দুটিও আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভঙ্গকরণ ইত্যাদি। সুদীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন, সেটিই ঈদুল ফিতর।

সারা বিশ্বের মুসলমানের সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর। বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে পারার পবিত্র অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। আর আনন্দ পুণ্যের অনুভূতিই জগতে এমন এক দুর্লভ জিনিস, যা ভাগাভাগি করলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায়। ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সানন্দে ঘোষণা করেছেন,  ‘প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে এই ঈদ। (বুখারী মুসলিম)

ঈদ ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। ঈদের দিন ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির, মালিক-শ্রমিকনির্বিশেষে সব মুসলমান এক কাতারে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় এবং একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে সাম্যের জয়ধ্বনি করেন। রমজান মাসে সংযম আত্মশুদ্ধি অনুশীলনের পর ঈদুল ফিতর ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে, গড়ে ওঠে সবার মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ঐক্যের বন্ধন। ঈদের দিন মসজিদে, ময়দানে ঈদের নামাজে বিপুলসংখ্যক মুসল্লির সমাগম হয়ে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে ধনী-নির্ধন, পরিচিত-অপরিচিত সবাই সানন্দে কোলাকুলি করেন।

 

প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়।

 মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে আমাদের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা  জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানিমুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ়তর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক! হাসি-খুশি ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুকএটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। তাই আসুন, ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার প্রাণে-মনে।

ঈদ আমাদের সামষ্টিক জীবনে যে মিলন শুভবোধ চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তা সঞ্চারিত হোক সবার প্রতিদিনের জীবনযাপনে। নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, ঈদ হোক জীবনকে নবায়ন করার আহ্বান। ঈদের আনন্দ হোক সর্বজনীন।



 

 

 



No comments

Powered by Blogger.