মামলা করায় আইনজীবী একঘোরে, স্বাক্ষীর অবস্থাও একই
স্টাফ রিপোর্টার-
নুর-ই-আলম পেশায় একজন আইনজীবী। এই আইনজীবীর পরিবারকেই সমাজপতিরা বে-আইনী ভাবে একঘোরে করে রেখেছেন। তিনি বাদি হয়ে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মারামারি মামলা দায়ের করায় এই একঘোরে করা হয়েছে। শুধু তাকেই নয়, আইনজীবীর দায়েরকরা ওই মামলার স্বাক্ষী হওয়ার অপরাধে হতদরিদ্র কৃষি শ্রমিক সিরাজুল ইসলামের পরিবারকেও একই ভাবে একঘোরে করেছে সমাজপতিরা।
প্রায় ২ মাস এই দুইটি পরিবারের ১০ সদস্য সমাজের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারছেন না। ঘটনাটি ঝিনাইদহ মহেশপুর উপজেলার জলিলপুর গ্রামের। কারিকর সম্প্রদায়ের সমাজপতিরা একঘোরের এই আদেশ গ্রামের লাল মোহাম্মদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পৌছে দেওয়ার পর এখন পরিবার দুইটির সঙ্গে কেউ মিশছেন না। গ্রামের দোকানীরাও মালামাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি একঘোরে হওয়া সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী সাবিনা খাতুন বাড়িতে বাচ্চা পড়িয়ে অর্থ উপার্যন করতেন, সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তারা অসহায় জীবন-যাপন করছেন।
আইনজীবী নূর-ই.আলম জানান, তিনি ঝিনাইদহ জজ আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট এ আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। তিনি জানান, তার বাবা শামছুল আলম মহেশপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর। তার চারটি বোন আছে, যার মধ্যে একটির বিয়ে হয়েছে, বাকি ৩ টা বাড়িতেই থাকেন। তিনি পেশার প্রয়োজনে ঢাকায় থাকেন। তিনি আরো জানান, জলিলপুর গ্রামের মহিদুল ইসলাম, কিয়ামত আলী ও নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে জমি নিয়ে তাদের একটা বিরোধ চলছিল। ঘটনার দিন ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে আসামীরা তার বাড়িতে প্রবেশ করে হামলা চালায়। তারা আইনজীবীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে যায়। এ সময় তার বোন বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করা হয়। এই ঘটনার পরদিন তিনি ঝিনাইদহ আদালতে মহিদুল ইসলাম, কিয়ামত আলী ও নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি আরো জানান, এরা সম্পর্কে তাদের আত্মিয়। তারপরও জীবন রক্ষায় এই মামলা দায়ের করেন। নূর-ই-আলম জানান, এই মামলা দায়েরের পর থেকে তাদের গ্রামের কতিপয় সমাজপতি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাদের সঙ্গে অন্যদের মেলামেশা না করার জন্য বলেন। যেটা কিছুটা গোপন ছিল, যার কারনে অনেকেই তাদের সঙ্গে মিশতেন আবার অনেকে মিশতেন না।
তিনি আরো বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর আদালতে তিনি যে মামলা দায়ের করেন সেই মামলায় তিনজন স্বাক্ষী আছেন। যার মধ্যে তাদের গ্রামের হতদরিদ্র সিরাজুল ইসলাম স্ত্রী সাবিনা খাতুনও আছেন। গত ২২ নভেম্বর গ্রামের ওই সমাজপতিরা সাবিনা খাতুনের বাড়িতে যান এবং মামলায় স্বাক্ষী হওয়ার কারণ জানতে চান। সেখানে উভয়ের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে সমাজপতিরা সাবিনার পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্ক না রাখার জন্য গ্রামের মানুষের জানিয়ে দেন। এটাও ছিল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই। তবে সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর সমাজপতিরা গ্রামে সভা করে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের একঘোরে করেছেন। ওই দিন রাতে জলিলপুর পাঁচ রাস্তা মোড়ে সমাজপতি চাঁদ আলীর সভাপতিত্বে সভা করেন। তারা সেখানে সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন এখন থেকে গ্রামের কারিকর সম্প্রদায়ের কেউ এই দুই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিশতে পারবেন না। যা পরদিন সকালে গ্রামের বাসিন্দা লাল মোহাম্মদকে দিয়ে বাড়ি বাড়ি এই বার্তা পৌছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি এই দুইটি পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে চলমান সবগুলো মামলা সমাজের লোকজন অর্থদিয়ে পরিচালনা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকে পরিবার দুইটি একঘোরে রয়েছে। অবশ্য মারামারি মামলার বিষয়ে আসামীদের একজন মহিদুল ইসলাম জানান, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। সমাজের সবাই এর প্রতিবাদ করেছেন। তাই তারা সমাজ মানেন না, তাই তাদের সমাজের বাইরে রাখা হয়েছে।
একঘোরে থাকা সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী সাবিনা খাতুন জানান, ইতিমধ্যে সমাজের লোকজনের দায়েরকরা মামলায় তার স্বামী-সন্তানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। পরে জামিন নিয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন বাড়ি ছাড়া ছিলেন। এখন বাড়িতে আসলেও গ্রামের তাদের সমাজের কেউ কথা বলছেন না। তার স্বামী অন্যের জমিতে কৃষি কাজ করেন। তাকেও কাজে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বাড়িতে ১২ টি বাচ্চা পড়াতেন, সেখানেও বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। তারা এখন আর পড়তে আসে না। তিনি অবশ্য অভিযোগ করেন, তার মেয়েটি সংগীতে অনেক ভালো। জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে সে। এই মেয়েকে গান শেখাতে নিয়ে যান এটা অনেকে অপচ্ছন্দ করেন। এখন স্বাক্ষী হওয়ার বিষয়টিকে পুজি করে তাকে একঘোরে করা হয়েছে। নূর-ই-আলম বলেন, তিনি আইনজীবী হয়েছেন। সমাজের লোকজন তাদের প্রভাব রাখতে যে সকল বে-আইনী কাজ করতে চান, তিনি অনেক সময় তার প্রতিবাদ করেন। এখন মারামারির একটি মামলাকে সুত্র করে এই একঘোরের মতো বে-আইনী কাজ করেছেন।
এ বিষয়ে ওই সমাজের সভাপতি চাঁদ আলী মুটোফোনে জানান, তাদের সঙ্গে ওই দুই পরিবারের লোকজন মিছতে চান না, যে কারনে তারা সমাজচ্যুত রয়েছে। আর ওই সভায় উপস্থিত সমাজ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহাকুল হোসেন জানান, তারা সমাজ মানতে চান না। যে করনে সমাজের লোকজন সভা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এই একঘোরের পক্ষে ছিলেন না, তারপরও সকলের ইচ্ছায় এটা হয়েছে। তিনি দাবি করেন উভয়পক্ষ বসলে এই সমস্যার সমাধান হবে।
এ ব্যাপারে মহেশপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শ^াশতী শীল জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। কেউ তার কাছে এ জাতীয় কোনো অভিযোগ দেয়নি, অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
No comments