“সুখের সন্ধানে” (৬ষ্ঠ পর্ব)
আলহাজ¦ এম. এ. কাদে (সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)-
একজন মানুষ তখনই আত্মহত্যা করে, যখন সে পরিস্থিতিকে ট্যাকল করতে পারে না। আমরা সব সময় ভাল আশা করব, উত্তমটিই আশা করব, যা কিছু হবে ভাল হবে, সেরা হবে। যদি তা না হয় তবে যা ঘটল তা এই পরিস্থিতির জন্য অনিবার্য ভাবতে হবে। সুতরাং সেটি যদি দূর্ঘটনা বা খারাপ কিছু হয়, তবে তার কারণগুলো খুঁজে বের করে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে করে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে। এই অভিজ্ঞতায় এগিয়ে যেতে হবে। যে চিন্তা আমার মনকে অস্থির করে তা পজিটিভ থিংকিং নয়, বরং যে চিন্তা আমার মনকে শান্তি দেয় বা শান্ত করে, নতুন কিছু করার উৎসাহ, উদ্দীপনা দেয়, তাই পজিটিভ থিংকিং। যে চিন্তা হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি করে তা কখনোই পজিটিভ থিংকিং নয়। বরং তা শরীর-মনকে নেতিবাচক চিন্তাই আক্রান্ত ও অসুস্থ করে সুখ নষ্ট করে। শ্রদ্ধা, পরোপকারিতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সেবা, অন্যের কল্যাণ কামনা, ভালোবাসা সৃষ্টিকারী ভাবনাই হলো পজিটিভ থিংকিং। যার ফলাফল হলো শান্তি। আর এই খুশি ও সন্তষ্টিই জীবনে বয়ে আনবে সুখ।
অনেক সময় সমাজের শ্রেণি বৈষম্যও সুখ নষ্ট করে। প্রতিবেশীর কেউ সৈয়দ,কাজী , খন্দকার, ব্রাহ্মণ , আবার কেউ বা বেয়ারা, নাপিত, দাস, জেলে, বেদে। এসমস্ত শ্রেণি বৈষম্যের কারণে সমাজে যারা উচ্চ শ্রেণির মানুষ বলে দাবি করেন তারা এদেরকে ছোট জাত মনে করে ঘৃণা করে। এ কারণে নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেকে ছোট মনে করে অসহায় বোধ করে। ফলে তার সুখ নষ্ট হয়। যেমন ব্রাহ্মণ, সৈয়দ থেকে চৌধুরীরা, বেয়ারা, দাস, জেলে, মালো, বেদে- সম্প্রদায় কে একেবারেই মূল্যায়ন করেনা। সামাজিকভাবে এদেরকে ছোট জাত বলে হেয় করা হয়। এদের সাথে খাওয়া দাওয়া, চলা-ফেরা, বিয়ে-শাদী, প্রেম-ভালোবাসা কোন কিছুই চলে না। এমনকি ছোট জাতের হাতের ছোঁয়ায় উচ্চশ্রেণির মর্যাদা ক্ষুণœ হওয়ায় সুখ নষ্ট হয়। বিষয়টি অনেক পূর্বেই পরিবর্তন হওয়া দরকার ছিল। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু আজ পর্যন্ত শ্রেণি বৈষম্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আসলে বিষয়টি কি জানেন? শ্রেণি বৈষম্য মানুষেরই সৃষ্টি। অনেক আগে যখন বেচা কেনার জন্য মুদ্রা সৃষ্টি হয়নি তখন মানুষের প্রয়োজনে শ্রম বিনিময় হতো। এ সুযোগে সমাজের চতুর লোকেরা বর্তমানে যারা উচ্চ শ্রেণি সৈয়দ, কাজী, ব্রাহ্মণ, এরাই সমাজের দাস, বেয়ারা, বেদে, মালো এদেরকে বিভিন্নভাবে শোষন ও নির্যাতন করা হলে তারা আজ দরিদ্র। আর এই দারিদ্র্যর কারণেই আজ তারা নিচু জাত। গরিব মানুষ অভাবের সময় যখন জীবন বাঁচানোর তাগিদে খাবার জোগাড়ে ব্যস্ত, তখন নতুন কাপড় কেনা তাদের জন্য অসম্ভব ছিল। অনেক সময় জোড়াতালি দিয়ে পুরাতন কাপড় সেলাই করে চালিয়ে যেত। দৃশ্যত কারিগর সম্প্রদায় কাপড় বিক্রি না হওয়ার কারণে অভাবে পড়তো। একই নিয়মে নাপিত, দাস, বেদে, বেয়ারা, জেলে, মালো প্রভৃতি সম্প্রদায় অভাবের সময় কর্ম বিনিময় না হওয়ার কারণে গরিব থেকেই যায়। তাছাড়া এখনকার মত মানুষের উচ্চাশা না থাকায় তখন তাদের পেশা পরিবর্তনের চেষ্টা করেনি। পৈতৃক পেশার কারণে তারা গরীবই থেকে যায়। আর এই সহজ-সরল ভালো মানুষগুলোই আজ নিচু জাত হিসাবে পরিচিত। যখন মানুষের অর্থ না থাকে তখন তারা পারিবারিক, সামাজিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায় হীনমন্যতায় ভোগে। ফলে তাদের সুখ নষ্ট হয়। শ্রেণি বৈষম্য ছোট-বড়, উঁচু-নিচু ও অর্থের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এখনও অনেক পরিবারে দেখা যায় দাদার নাম সলিম উদ্দিন, ছেলেদের কেউ স্থান ত্যাগ করে ঢাকায় গিয়ে পয়সাওয়ালা হয়ে নাম হয়েছে চৌধুরী কলিম সাহেব। একইভাবে সলিম উদ্দীন পদবী পরিবর্তন করে কেউ চৌধুরী, কেউ কাজী, কেউ খন্দকার কেউ সৈয়দ, কেউ সাহেব, আবার কেউবা বাবু হয়েছেন। কাজেই সমাজের কাউকে ছোট করে দেখে তার সুখ নষ্ট না করে, তার কাজকে মূল্যায়ন করাই উত্তম। জাত-কুল নয়, তার যোগ্যতা বা কাজকে মূল্যায়ন করলেই সমাজে সুখ ফিরে আসবে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় জাত-কুল-মান নিয়ে এ পর্যন্ত কত মানুষেরই না সুখ নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবেশী চৌধুরীর মেয়ের সাথে চাষীর ছেলের ভালোবাসায় জাত-কুল ঠেকাতে লাঠি যুদ্ধে ১৫ জন আহত, ১ জন নিহত এমন ঘটনা কতইনা ঘটে থাকে। প্রেমিক-প্রেমিকার আত্মহত্যার ঘটনা অহরহ আমাদের দেশে সব সময় ঘটে থাকে। কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে কয়েক পুরুষ আগেই দেখা যাবে ওই চৌধুরী একসময় চাষী ছিলো। সাহসী ভুমিকার কারণে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আজ সে সৈয়দ, কাজী, চৌধুরী, বাবু, সাহেব হয়েছে। কালের বিবর্তণে সুযোগ সুবিধার অভাবে সৈয়দ, চৌধুরী, রায়, ব্রাহ্মণ, ভট্টাচার্য একসময় বিলীন হয়ে যাবে। অপ্রত্যাশিত কেউ নেতা হয়ে সাহসী ভুমিকা নিয়ে যোগ্যতা দিয়ে শতকোটি টাকার মালিক হয়ে সমাজের উঁচু স্থান দখল করবে এটাই নিয়ম। টাকা যার হাতে, শক্তি-সাহস-ক্ষমতা, মান-সম্মান, জাত-কুল তারই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অন্য কিছু নয়, ভাঙ্গা-গড়াই নিয়তির খেলা।
No comments