এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছি আমরা
এম. এ. কাদের (সাংবাদিক) -বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এলক্ষ্যে ২০২১ সালকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌছানো সম্ভব হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সাহসী নেতৃত্বের জন্যই করোনাকালে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮.২ ধরে সংসদে চলতি অর্থবছরের বাজেট পাস করা হয়েছে। পররাষ্ট্র নীতিতে নিজ দেশের মর্যাদা সমুন্নত রেখে কী প্রতিবেশি, কী ক্ষমতাধর রাষ্ট্র সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই বাংলাদেশ উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নেতৃত্বে এখন শেখ হাসিনার অবস্থান সবার শীর্ষে।
অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদন্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দমমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ। ওয়াল্ড ব্যাংকের মতে, ১৯৯১ সালে আমাদের দেশে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১৯ এ সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে (ঢাকা ট্রিবিউন)। ২০১৮’র তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪৪তম অর্থনীতির দেশ আর ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২তম।
স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে “জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১”। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোতে ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
শিক্ষাখাতে বর্তমান ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে।
কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। কৃষিকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়া, ভর্তুকি দেওয়া, সার, তেল, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি সরঞ্জাম দিয়ে কৃষি খাতকে একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন বর্তমান সরকার। ফলে আমরা খাদ্য উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ধান ও মাছ উৎপাদনেও বিশ্বে অনন্য রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎখাতে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন করা হয়েছে, যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫ লক্ষ গ্রাহককে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে গভীর সমুদ্রের তলদেশে অপটিক্যাল ফাইবার, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মোবাইল ব্যাংকিং, উপজেলা শহরে বসেছে ব্যাংকের এটিএম বুথ, সহজলভ্য ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গণে ২০১৯ সাল মূলত শেষ হয় দক্ষিণ এশিয়ান গেমস দিয়ে যেখানে বাংলাদেশ মোট ১৯টি স্বর্ণপদক পায়। মূলত আর্চারী, ভারোত্তোলন ও কারাতের ইভেন্টগুলোতে বাংলাদেশ সফলতা লাভ করে। মারিয়া আক্তার সীমান্ত ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক পায়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ ছিলেন আর্চার রোমান সানা। যিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। মূলত বিশ্ব আর্চারীতে ব্রোঞ্জ পদক জিতে এবং এশিয়ান আর্চারীতে স্বর্ণপদক জয় তাকে এই লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে। ২০১৯ সালেই দুইবারের আর্চারী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কিম-ওজিনকে পরাজিত করেন রোমান সানা।
বিশ্বদরবারে ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে বাংলাদেশ তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এ যাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে।
শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপই বাংলাদেশকে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে গেছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের নতুন মাইলফলক হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশেষ করে ভারী শিল্পের উন্নয়ন এবং পদ্মা সেতু, মেট্রারেলসহ বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে তাঁর নেওয়া সাহসী পদক্ষেপ বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের চলমান মহামারী থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে যেসব উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন সেগুলোও অত্যন্ত ফলপ্রদ ভূমিকা রেখেছে। ফলত চলমান মহামারীতেও অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুহার অনেক কম। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোয় যেখানে মৃত্যুহার ১৫-২০ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ছিল ২২৭.৭৫ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ১৯,৩১৪ টাকা। শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২৯.২৩%। ২০১১ সালে, ৩০ বছরের ব্যবধানে এই বাৎসরিক আয় ছিল ৮৬১.৭৬ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৭৩,০৭৮ টাকা। শিক্ষিতের হার ছিল ৫৮.৭৭% এবং দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১.৫%। ২০১৮ সালে মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৯৮.২৬ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ১,৪৪,০১৩ টাকা। শিক্ষিতের হার এবং দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৭৩.৯১% ও ২১.৮%। ১৯৮১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৩০ বছরে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে মাত্র ৫৪ হাজার টাকা, এবং শিক্ষিতের হার বেড়েছে প্রায় ২৯%। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০১৮ সালে, মাত্র ৭ বছরে এই মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৭১ হাজার টাকা, শিক্ষিতের হার বেড়েছে ১৬% এবং দারিদ্র্যের হার কমেছে প্রায় ১০%। দেশ এ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আরেকটি বিজয়ের ইতিহাস রচিত হলো নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। পদ্মা সেতু শুধু একটা সেতু নয়, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে একটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক। শুধ দলমত নির্বিশেষে নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই এই শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের বহু অপূরণীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে।
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
makader958@gmail.com
No comments