“সুখের সন্ধানে” (৪র্থ পর্ব)

আলহাজ্ব এম. এ. কাদের

(সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)-

আবেগ আমাদেরকে সর্বদা তাড়িত করে ফেরে। আবেগ যেমন আমাদের সুখানুভূতি সৃষ্টি করে- তেমনি এই আবেগই আমাদেরকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করতে প্ররোচিত করে। তাই সময়মত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যেমন অতিরিক্ত ক্রোধ আমাদের লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করে লিভারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। অধিক ধুমপান ও দুষিত খাবার আমাদের পাকস্থলি, লিভার ও  ফুসফুসের ক্ষতি হয়। অধিক দুঃশ্চিন্তায় পাকস্থলীতে পাচক রস নিঃসরণে বাঁধার সৃষ্টি হয় এবং খাবার হজমে ব্যাঘাত ঘটায় ফলে পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গ্যাষ্ট্রিক ও আলসারের সৃষ্টি করে। প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১০ গ্লাস পানি পান না করলে অত্যন্ত গুুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনী নীরবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মানসিক চাপ,লবণ ও কোলেষ্টরল যুক্ত খাবার বেশি খেলে হার্ট এবং ব্রেনের মারাত্মক ক্ষতি করে, ফলে হার্ট এ্যাটাক বা ব্রেন ষ্ট্রোকের মত বিপর্যয় ঘটাতে পারে। বৃহদ্রান্ত কার্জকারিতা হারাতে পারে, ভাজা পৌড়া ঝাল মসলা যুক্ত খাবার বেশি খেলে। ক্ষদ্রান্ত ক্ষতি হতে পারে যদি আপনি ঠান্ড ও বাশি খাবার নিময়িত খেলে । অগ্নাশয় ক্ষতি হবে প্রচুর মিষ্টি জাত খাবার খেলে। চোখের জ্যোতি কুমতে পারে অন্ধকারে বেশি সময় ধরে মোবাইলে এবং কম্পউটারে স্কানের আলোয় কাজ করলে। কাজেই শারীরিক-মানশিক পারিপার্শ্বিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক,রাজনৈতিক যত চাপই আসুক না কেন আপনার সহ্য ক্ষমতা ঠিক থাকলে টেনশন মুক্ত সুখ পাওয়া সম্ভব।

সকল সুখ নষ্টের কারণ হলো টেনশন কাজেই টেনশন মুক্ত জীবনের জন্য ৩টি বিষয় মনে রাখতে হবে,  ১। কি খাচ্ছেন?  ২। কি ভাবছেন?  ৩। কি  করছেন?

খাদ্য নির্বাচন ঠিক করতে হবে। সঠিক সময়ে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। চিন্তা ভাবনা ইতিবাচক করতে হবে। নেগেটিভ দৃষ্টি ভঙ্গি পরিত্যাগ করে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। আপনার বয়স ও প্রাত্যহিক কাজের ধরন বুঝে ব্যায়াম করতে হবে। নিজেকে ও পরিবারকে সময় দিতে হবে। নিজের ও অন্যের কল্যাণ কামনা করতে হবে। ভ্রমণ ও বিনোদনের জন্য সময় বের করতে হবে। আর ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে মানসিক চাপ মুক্ত সুন্দর ও সফল জীবন গড়ে তোলা সহজ হবে। আমাদের একটি ধারণা আছে, “অর্থই সকল সুখের মূল”, অর্থাৎ অর্থের মাপ কাঠি দিয়েই সুখ নিরুপণ করা হয়।  এটা সঠিক নয়। অন্যের ধনসম্পদ, গাড়ি-বাড়ি দেখে পরশ্রীকাতরতায় অনেকের সুখ নষ্ট হয়। একটি প্রবাদ আছে, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস। একারণে আমরা অনেকেই বৈধ-অবৈধ পথে এমনকি জীবন বাজি রেখে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমাদের গবেষণার বিষয়, অর্থেই কি সকল সুখ? আসলে বিষয়টি তা নয়, বিষয়টি হলো যার আছে যত বেশি তার চাহিদাও তত বেশি। এখানেই সৃষ্টিকর্তা সুখকে ধনী-গরিবের মাঝে সমান ভাবে বন্টন করেছেন। একজন রিক্সা চালকের চাহিদা হলো ২৫ হাজার টাকা দামের ১টি রিক্সা ক্রয় করা। এটি করতে পারলে রিক্সাটা তার নিজের হবে এবং প্রতিদিন রিক্সা মালিককে আর ভাড়া দেওয়া লাগবে না। তার প্রতিদিনের আয় থেকে খরচ করে কিছু টাকা বাচিয়ে ৩০০০ টাকা জমাতে পারলেই ছেলে-মেয়ের পোশাক কিনে বস্তির ব্র্যাক স্কুলে পাঠাতে পারলে, এটাই তার বড় চাওয়া। আর এ চাহিদার কারণেই টেনশনে সে সুখী হতে পারছে না। একইভাবে একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির জেলা শহরে বাড়ি থাকা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকা শহরে একটি বাড়ি না থাকার তার ছেলেমেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে  পড়তে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকায় বাড়ি না হওয়ায় বিষয়টি তার স্ত্রী মেনে নিতে না পারায় স্বামীকে সার্বক্ষণিক মানসিক চাপে রাখছেন। এ কারণে ওই ব্যক্তির টেনশন বৃদ্ধি পাওয়ায় সুখ বিনষ্ট হচ্ছে। এ ভাবে সমাজের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি যিনি শত শত কোটি টাকার মালিক, রাজধানী শহরে তার শত শত বাড়ি-গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অধিক টেনশনে তারও সুখ নষ্ট হচ্ছে। কারণ তার পরিবারের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সবাই দেশের বাইরে থাকে। কেউ অস্ট্রেলিয়ায়, কেউ কানাডায়, কেউ বা আমেরিকায়। উচ্চ পর্যায়ের বিলাসী জীবন যাপনের চাহিদা মেটাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা দেখাশুনা ও ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের লেনদেন সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে উচ্চাভিলাসী  স্ত্রীর বায়না কানাডা, আমেরিকা এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, তাই তুমি অতিসত্বর বর্তমান পৃথিবীর  সবচেয়ে সুখের স্থল দুবাইয়ের সাগরের মধ্যে পাম জামিরায় ২ বিঘা জমির উপর একটি বিলাস বহুল ভবন তৈরি করে দাও। 

অস্ট্রেলিয়ার মেয়েটি আধুনিক বাড়ি ও  গাড়ির মডেল পরিবর্তনের জন্য বাবার কাছে বার বার তাগিদ দিচ্ছে। ছেলে বলছে, পৃথিবী এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে তাই দ্রুত মঙ্গল গ্রহে জমি কিনে দাও নতুবা বসবাসের শেষ স্থানটুকুও হারাতে হতে পারে। এসকল চাহিদা পূরণের চিন্তায় বাবা  দুঃশ্চিন্তায় দ্বিতীয় বারের মত হার্ট অ্যাটাকের আশংকায় রয়েছেন। উপর্যুক্ত উদাহরণে আমাদের পরিষ্কার একটা ধারণা হয়েছে যে, দিনমজুর থেকে শুরু করে সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের মানুষের মধ্যে অধিক চাহিদার কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হওয়ায় কেউ সুখী হতে পারছে না। পার্থিব অর্থ সম্পদ ভোগ, এ সবের আকাঙ্খা এবং তৃপ্তির শেষ নেই। যার ফলে আকাঙ্খা ও ভোগের দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়েছে। যার ফলে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। চাহিদার সাথে যখন প্রাপ্তির মিল হয়না তখনই মানসিক চাপ তৈরি হতে থাকে।

আমরা কি পাইনি সেটাই শুধু ভাবছি।  কিন্তু কত কিছু পেয়েছি, সেটাতো ভাবছি না। সংসারে কি পাওয়া উচিত ছিল সেটা ভাবছি, কিন্তু কি দেওয়া উচিত ছিল সেটা কখনো ভেবেছি ? ধন থাকলেই সে ধনী নয়, ধনী সেই যে তার ধন অকাতরে বিলিয়ে দিতে পেরেছে। আমরা এ জীবনে  যতটা পেয়েছি ততটা কি দিতে পেরেছি? আসলে দেয়ার মধ্যে শান্তি, দেয়ার মধ্যেই সুখ।  মানুষের মৃত্যুর পর তার মূল্যায়ন হয়। তিনি কেমন মানুষ ছিলেন বা সমাজকে কতটা তিনি  দিতে পেরেছেন। অথচ আমরা পাওয়ার জন্য অস্থির হচ্ছি, ফলে টেনশন বাড়ছে এবং সুখ হারাচ্ছি। সমাজ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন মানুষের ব্রেনে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, টেনশন, ডিপ্রেশন  বাসা বেঁধে থাকার কারণে অনেক মেটাবলিক রোগের সৃষ্টি হয়। যেমনঃ ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, পেটের আলচার প্রভতি। কিন্তু মুখের হাসি বজায় রাখতে পারলে ব্রেনের দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, টেনশন, ডিপ্রেশন প্রভৃতি নেতিবাচক অনুভূতিগুলো অপসারিত হয়ে  মনটা সুখ, শান্তি, আনন্দ,ও অনুভুতিতে ভরে ওঠে। ফলে ঐ সব ক্রনিক রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। এ কারণে গবেষকরা বলেছেন, অধিকাংশ রোগের কারণ নিরানন্দ বোধ করা। এর ফলে  সাইকো সোমাটিক ডিসঅর্ডার বা মনোদৈহিক রোগ সৃষ্টি হয়। ভারতের প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী বি, কে চন্দ্রশেখর বলেছেন, সুখের জন্য রোগ নিরাময় তথা অটোহিলিং ঠিক রাখতে দুইটি ম্যাজিক ক্যাপসুল রয়েছে, তা হলো ভালোবাসা ও হাসি। একটি সুন্দর হাসিই পারে আপনাকে মানসিক চাপ ও শারীরিক চাপ থেকে মুক্ত রেখে শরীরের কোষের ডি এন এ  এক্সপ্যানশন করতে- যা সুস্থ থাকতে সহায়ক। আর যদি আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় থাকেন, তবে আপনার ডি.এন.এ হবে সংকুচিত যা সুস্থতার জন্য নেতিবাচক। মানুষ যদি দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায়, হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায় মন খারাপ করে থাকে তবে এর প্রভাব তার নিজের শরীরের উপরে পড়বে। নিজের শরীরের আশীর্বাদ জলীয় পদার্থ কে অসুন্দর বিকৃত করে তুলবে এবং সুখ নষ্ট করবে। সুতরাং কারো প্রতি ঈর্ষা বা বদনাম নয় বরং অন্যের জন্য শুভকামনা, ভালো চাওয়াটাই নিজের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট সহায়ক হবে। হাসির গুরুত্ব অনেক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র ১৫ সেকেন্ড হাসলে  ২ দিন আয়ু বৃদ্ধি পায়। হাসি শরীরের হরমোনের নিঃসরনের ভারসাম্য বজায় রাখে, ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।


                                                                                                                                                   Email: makader958@gmail.co

Phone: 01711-338182, 01916-604161

Facebook page: facebook.com/makader1958

 

1 comment:

Powered by Blogger.