ইবি’র প্রাক্তন ছাত্রী তিন্নির মৃত্যু রহস্যের নেপথ্যে বেরিয়ে আসছে দুই কাহিনী
মিজানুর রহমান ও তরিকুল ইসলামঃ
ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ইবি’র প্রাক্তন ছাত্রী উলফাত আরা তিন্নির মৃত্যু রহস্য এখনও উন্মোচিত হয় নি। তবে ঘটনাটি তিন্নির পরিবার সংশ্লিষ্ট ও মেঝ বোন মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলের সাথে কলহ বিবাদে তিন্নি আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়েছে বলে তিন্নির স্বজন ও প্রতিবেশিরা ধারনা করছেন। তিন্নির মৃত্যু নিয়ে মেঝ বোন মুন্নি ও তার মা কোন কথা না বললেও বড় বোনের স্বামী তিন্নির মৃত্যুর ঘটনায় মুন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলকে দায়ী করনে। যদিও ঘটনার দিন তিনি শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন না বলে তিনি জানান।
তিন্নি’র বোন মুন্নির সাথে রাজু আহমেদ নামের এক ছেলের সম্পর্ক এবং বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তিপেতে অথবা মুন্নি ও তার ‘বর্তমান স্বামী রাজুকে’ শায়েস্তা করার পরিকল্পনা থেকে জামিরুলের পক্ষ থেকে তিন্নিকে মানষিক নির্যাতন ও সামাজিকভাবে পরিবারের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার আক্ষেপ থেকে আত্মহত্যা করতে পারে। রোববার সরেজমিন এলাকাঘুরে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
মামলার প্রধান অভিযুক্ত আসামি জামিরুর ইসলামের পরিবারের সদস্যরা জানান, তিন্নির বাবা মুক্তিযোদ্ধা মৃত ইউসুফ আলী ও জামিরুল ইসলামের মা গঞ্জেরা খাতুন মামাতো ফুফাতো ভাই বোন। ২০০৮ সালে এইচ এসসি পড়া অবস্থায় উভয় পরিবারের মতামতের ভিত্তিতে তিন্নি’র বড় বোন মুন্নির সাথে জামিরুলের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে জুনাইরা নামের ৬ বছরের একটি কন্যা সন্তানও আছে। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর জামিরুলের শশুর ইউসুফ আলী অসুস্থ হয়ে শয্যাসায়ী হয়ে পড়েন। তিন্নিরা তিন বোন। বাড়িতে কোন পুরুষ সদস্য না থাকায় তিন বছর ধরে জামিরুল তার শ^শুরকে ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে সকল ধরনের সেবা-শুশ্রুষা করে আসছিলেন। ২০১৯ সালের ৫ মার্চ জামিরুলের শশুর মারা যান।
মুন্নির বাবা বেঁচে থাকাকালীন সময়েই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ হতো। বাবা মারা যাওয়ার পর ২০১৯ সালের ২ আগস্ট মুন্নি জামিরুলকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। কিন্তু জামিরুল সেটি গ্রহণ করেনি। পূর্বের আত্মীয় হওয়ায় মুন্নি বাদে মুন্নির পরিবারের সদস্যদের সাথে জামিরুলের পরিবারের সাথে তাদের যোগাযোগ ও যাতায়াত অব্যাহত থাকে। জামিরুলের পরিবারে সদস্যরা একাধিকবার মুন্নির পাঠানো ডিভোর্স লেটার পাঠানোর কারণ জানতে চেয়ে কোন সদোত্তর পায়নি।
পরিবারের সদস্যদের আরও অভিযোগ স্বামী থাকা সত্বেও পাশ^বর্তী আনন্দনগর গ্রামের রাজু আহমেদ নামের এক ছেলের সাথে মুন্নির সম্পর্ক গড়ে উঠে। ওই ছেলের সাথে সে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতো। এসব তথ্য জানা সত্বেও জামিরুলের পরিবার মুন্নিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ডিভোর্জ লেটার পাঠানোর পরে লোকমুখে আমরা জানতে পারি মুন্নিকে রাজু বিয়ে করেছে এবং রাজু প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাতায়াত করে। কিন্তু মিন্নির মা বরাবরই বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিলেন। এদিকে লোকমুখে বিভিন্ন কথা শুনে বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ১ অক্টোবর রাতে জামিরুল তার ভাইদের নিয়ে মুন্নিদের বাড়িতে যায়। তারা যাওয়ার পর বাড়ির বাইরে থেকে উভয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও গোলযোগ হয়। সে সময় রাজু বাড়ির দরজা খুলে পালিয়ে যায় এবং
এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাড়ির বাইরে থেকে গোলযোগ হয়। আর তিন্নি রাজু আসার খবর টি জামিরুলকে জানিয়ে দিয়েছে এমনটি ভেবে পরিবারের সদস্যরা তিন্নিকে ব্যাপক বকাবকি করে। এছাড়া চারিদিকে উচ্চস্বরে বাকবিতন্ডা শুনে আশপাশের লোক তাদের বাড়ির পাশে ভিড় করে। সে সময় তিন্নি বলে, তোমরা এসব করে সমাজে আমার মানসম্মন নষ্ট করে দিলে। আমি কিভাবে বাইরে বের হবো। মানুষ কি বলবে। আমি এ জীবন আর রাখবো না বলে তিন্নি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় চলে যায়। তখন জামিরুল ও তার সাথে থাকা ভাইরা তিন্নিকে বাঁচানোর জন্য মুন্নি ও তার মাকে বাড়ির মেইন দরজা খুলে দিতে বলেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষন গোলযোগ চলার কারনে সময় ক্ষেপন হয় এর মধ্যে তিন্নি আত্মহত্যা করে বলে জামিরুলের পরিবার জানায়। জামিরুলের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ রাজু যদি মুন্নির স্বামী হবে তাহলে সে পালিয়ে গেল কেন?
তারা আরও জানায় আর এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছোট বোন তিন্নি খুবই অশান্তিতে ছিল। তাদের সংসারে ছোট একটি বাচ্চা থাকার কারনে তিন্নি চেয়েছিল মুন্নি ও জামিরুলকে এক করে দিতে। জামিরুলও প্রায়ই তিন্নিকে ফোন করতো মুন্নির সাথে কথা বলার জন্য। মাঝে মধ্যে তিন্নি মোবাইল ফোনে তার বোন মুন্নি’র সাথে কথা বলিয়ে দিত। তিন্নি’র সাথে জামিরুলের পরিবারের সম্পর্ক ভাল ছিল। জামিরুলসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে তিন্নি’র প্রায়ই কথাবার্তা হতো। কিন্তু জামিরুলের পরিবার সাথে যোগাযোগ থাকায় মুন্নি ও তার মা তিন্নিকে বিভিন্ন সময় বকাবকি করতো।
তবে এসব বিষয়ে তিন্নি’র বোন মুন্নি’র সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে চাননি। দীর্ঘক্ষন কানে ফোন ধরে কারো সাথে কথা বলছিলেন। বোনের মৃত্যুতে তার মুখে কোন শোকের ছাপ দেখা যায় নি। কথা বলার পরিবেশ নেই বলে ফোনে কথা বলতে বলতে তিনি দ্রুত বাড়ির দ্বিতীয় তলায় উঠে যান।
তবে তিন্নি বড় দুলাভাই লাফস গ্যাস কোম্পানীর সিনিয়র রিজিওনাল সেলস্ এক্সিকিউটিভ আবুল কালাম আজাদ জানান, ঘটনার দিন তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তবে জানতে পেরেছেন প্রাক্তর স্বামী জামিরুলসহ বেশ কয়েকজন রাত ৮ টার দিকে তিন্নিদের বাড়িতে আসে। সে সময় নীচের গেট খোলা ছিল। তারা উপরে উঠে গোলযোগ করে চলে যায়। এর কোন এক সুযোগে জামিরুল নাকি তিন্নি’র রুমের খাটের নীচে ছিল। পরে রাত ১০ টার পুনরায় অন্যান্যরা তিন্নিদের বাড়িতে এসে গোলযোগ করে। জামিরুলের পক্ষের লোকজন তাদের ঘরে প্রবেশ করে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে মুন্নিরা আগতদের বাড়িতে আটকে ফেলার চেষ্টা করে। এ সময় সবাই দরজা খুলে পালিয়ে গেলেও জামিরুল বাড়ির সিঁড়ির কাঁচ ভেঙ্গে পালিয়ে যায়। প্রথমবার এসেই খাটের নীচে জামিরুল লুকিয়ে ছিল বলে তিনি ধারনা করেন। মুলত সে মুন্নিকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেই এসেছিল। যখন খাটের নীচ থেকে শব্দ আসে তখন হয়ত সে (তিন্নি) জামিরুলকে দেখে ফেলে এ সময় জামিরুলসহ পরে আবার আসা জামিরুলের লোকজন তিন্নিকে পাশবিক নির্যাতন করতে পারে। বিষয়টি জানাজানি হলে সমাজে কিভাবে মুখ দেখাবে এমন কষ্ট, ঘৃণা, আত্মসম্মানের কারনে সে হয়ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। পরে দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়ায় নেয়া হলে ডাক্তার তিন্নিকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে রাজুর সাথে মুন্নির বিয়ে বিষয়ে তিনি জানান, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। কিন্তু এটা কেউ তাকে আগে জানায়নি। তিনি সামাজিক ভাবে তাদের বিয়েটি দেয়ার জন্য মুন্নির পরিবারকে পরামর্শ দেন।
তিন্নির মা হালিমা বেগমের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি অসুস্থ থাকার অজুহাতে তার সাথে কথা বলতে বা বাড়িতে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া হয়নি।
জামিরুলের পরিবারের সদস্য ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, তিন্নি মেয়েটি অনেক ভাল ছিল। সে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ শিক্ষা বর্ষের ছাত্রী ছিল। হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি সাবজেক্টে অনার্স মাস্টার্স শেষে করে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। তার মৃত্যুর বিষয়টি তাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে।
জামিরুল ইসলামের শেখপাড়া গ্রামের বয়স্ক দোকানী আয়ুব হোসেন, একই এলাকার যুবক রাফিউল ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, জামিরুল একজন শিক্ষিত ছেলে। তিনি বিএ পাস করে ডেন্টালের একটি কোর্স করে তাদের জেস্ট ফার্মেসিতে বসে দাঁতের চিকিৎসা দিতেন। তার স্ত্রী সম্পর্কে কেউ খারাপ মন্তব্য করলে সে ওই ব্যক্তির উপর ক্ষেপে যেতেন। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। সে তার শ্যালিকাকে নির্যাতন করে হত্যা করতে পারে এটা তাদের কল্পনায়ও আসেনা।
ত্রিবেনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল হক খান জানান, তিন্নির বড় বোন মুন্নি তার স্বামীকে বেশ কিছুদিন আগে ডিভোর্স দেয়। ডিভোর্স দেওয়ার পর রাস্তা ঘাটে তাকে বিরক্ত করতো। এ বিষয়ে মুন্নি ইউনিয়ন পরিষদে একটি অভিযোগ দেয়। আমি অভিযোগ পেয়ে উভয় পক্ষকে নোটিশ করি। কিন্তু বিচারের দিন জামিরুলরা কেউ আসেনি। এরপর রাস্তা ঘাটে বিরক্ত করা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে মর্মে আমি তাদের চিঠি দিয়ে সতর্ক করি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শৈলকুপা থানার ওসি (তদন্ত) মহাসিন হোসেন জানান, তিন্নির মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার রাতে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ আরো অজ্ঞাত ৫-৬ জনের নামে শৈলকুপা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং আত্মহত্যা প্ররোচণার আইনে মামলা হয়েছে। তিন্নির মা হালিমা বেগম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেছেন। মামলার পর পুলিশ শেখপাড়া গ্রামের কনুর উদ্দিনের ছেলে আমিরুল, নজরুল, লাবিব ও তন্ময় কে গ্রেপ্তার করেছে। এ মামলার প্রধান অভিযুক্ত আসামি জামিরুল পলাতক রয়েছে। তিনি আরো বলেন, মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসলে তিন্নি কে হত্যা করা হয়েছে নাকি সে আত্মহত্যা করেছে সেটি জানা যাবে।
No comments