ভাইরাস ও ভ্যাকসিনের ক্রমবিকাশ
মোঃ রবিউল হাসান -
ভাইরাস: এই করোনা কালীন সময়ে যে বিষয়টা বেশি আমাকে বেশি ভাবিয়েছে সেটা হল ভাইরাস ৷ তাই ভাইরাস সম্পর্কে লেখার ক্ষুদ্র প্রয়াস ৷
ভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষা থেকে গৃহীত, যার অর্থ বিষ ৷ প্রাচীনকালে রোগ সৃষ্টিকারী যেকোন বস্তুকে ভাইরাস বলা হত ৷ আর বর্তমানে ভাইরাস বলতে আমরা বুঝি অতি ক্ষুদ্র আণুবিক্ষনীক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তু ৷ উদ্ভিদ ও প্রাণীর বহু রোগ সৃষ্টির কারণ এই ভাইরাস ৷ ভাইরাস এমনি এক অনুজীব যা কেবল জীবিত কোষে বংশবৃদ্ধি করতে পারে ৷ তাই যে কোন ভাইরাস কোন প্রাণীর সংস্পর্শে আসা মাত্রই আক্রান্ত প্রাণী বা উদ্ভিদের ক্ষতি সাধন করে ৷
ভাইরাস সাধারণত ডিএনএ,আরএনএ এবং নিউক্লিক এসিড দিয়ে গঠিত এক ধরনের প্রোটিন ৷ তাই ভাইরাস অকোষীয় ৷ ভাইরাস সাধারণত দুই প্রকার ৷
যথা: ১. ডিএনএ ভাইরাস
(দ্বিসূত্রক) ২. আরএনএ ভাইরাস
(একসূত্রক) ৷
হল্যান্ডের প্রাণ-রসায়নবিদ এডলফ মেয়ার (১৮৮৬) তামাক গাছের (TMV) মোজাইক নামক ভাইরাস নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন ৷ পরবর্তীতে রাশিয়ান জীবাণুবিদ দিমিত্রি ইভানোভস্কি ১৮৯২ সালে তামাক গাছ TMV ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত প্রমাণ করেন
৷ মার্কিন জীব রসায়নবিদ ডব্লু এম স্ট্যানলি TMV পৃথক করে কেলাসিত করতে সক্ষম হন এবং ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন ৷
ভাইরাসের অবস্থান ও আয়তন: উদ্ভিদ, প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, সায়ানো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি জীবদেহের সজীব কোষে ভাইরাস সক্রিয়ভাবে অবস্থান করে ৷ আবার নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বাতাস, পানি, মাটি ইত্যাদি প্রায় সব জড় মাধ্যমে অবস্থান করে ৷ আয়তনে ভাইরাস সাধারণত 100nm - 300nm পর্যন্ত হতে ৷ তবে কিছু ভাইরাস এর চেয়েও বড় হতে পারে
৷
ভ্যাকসিন: ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো কিভাবে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক ৷
ভ্যাকসিনের জনক বলা হয় এডওয়ার্ড জেনারকে ৷ ১৭৯৬ সালে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পরে ৷ সেসময় আক্রান্ত প্রতি তিন জনে একজন মারা যেত ৷ এ নিয়ে জেনার খুব ভাবতেন এবং বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তায় পরে গেলেন ৷ কিভাবে গুটি বসন্ত ভাইরাস নির্মূল করা যায় সে বিষয়ে ছক আঁকছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এক গোয়ালিনী কন্যা তার জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনল ৷ তিনি লক্ষ্য করলেন গোয়ালিনীর কন্যা সারা শহর দুধের যোগান দিচ্ছেন যে শহর গুটি বসন্তের প্রকোপে ভীত সন্ত্রস্ত ৷ জেনার চিন্তা করলেন এই মেয়ে সারা শহর ঘুরে বেরাচ্ছে অথচ গুটি বসন্ত তাকে আক্রান্ত করেনি কিভাবে সম্ভব ? যেহেতু গুটি বসন্ত মারাত্মক সংক্রামক বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এবং খুবই ছোঁয়াচে রোগ
৷
একদিন জেনার গোয়ালিনী মেয়েটির পিছু পিছু তার বাড়িতে গেলেন এবং অলিগলি তালাশ করতে লাগলেন
৷ তিনি লক্ষ্য করলেন গোয়াল ঘরের দিকে এবং দেখলেন গোয়ালিনীর গরুগুলো গো-বসন্তে আক্রান্ত ৷ তিনি আরও খেয়াল করলেন যে গোয়ালিনীর বাড়ির কেউই আক্রান্ত হননি
৷ সেখান থেকে সেদিন ফিরে আসলেন এবং নানারকম চিন্তা করতে লাগলেন ৷ বিভিন্ন রকম হাইপোথিসিস চালাতে লাগলেন এবং একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন
৷ তিনি ধরে নিলেন যে গো বসন্ত ভাইরাস গরু থেকে মানুষকেও আক্রান্ত করে, এই ভাইরাসটি গরুকে যতটা সংক্রমিত করতে পারে মানুষকে ততটা পারে না ৷ তাই মানুষ খুব একটা সমস্যায় পরে না ৷ একবার আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, ফলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে মানুষকে ততটা সংক্রমণ করতে পারে না ৷ যেহেতু গুটি বসন্তের ভাইরাস গরু থেকেই এসেছে, ফলে গোয়ালিনীর পরিবারে স্বভাবতই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে ৷
জেনার এসব বিষয় জ্ঞান অর্জন করে চিন্তা করলেন একজনকে গিনিপিগ মানব হতে হবে, যে স্বেচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করবে ভ্যাকসিন তৈরিতে ৷ একজন ৮ বছরের শিশু তার এ কাজে এগিয়ে আসলেন ৷ জেনার প্রথমেই ঝুঁকি নিলেন প্রথমে গো-বসন্ত বসন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত গরু থেকে জীবাণুযুক্ত তরল সংগ্রহ করলেন এবং ঐ গিনিপিগ শিশুর দেহে ক্ষত করে এই তরল প্রবেশ করালেন
৷ কিছুদিনের মধ্যে শিশুর দেহের সেই স্থান ফুলে ফেঁপে উঠল এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যে আবার ভালও হয়ে গেল
৷ তিনি বুঝতে পারলেন শিশুটির দেহ এখন গো বসন্ত বিরোধী ৷
জেনার এবার চিন্তা করলেন গুটি বসন্তের জীবাণু শিশুটির শরীরে প্রবেশ করালে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয় কিনা ৷ সেই চিন্তা থেকে শিশুটির দেহে গুটি বসন্তের জীবাণু প্রবেশ করালেন এবং লক্ষ্য করলেন যে, এই গুটি বসন্ত শিশুটিকে তেমন কোন সংক্রমণ করেনি বা ভাইরাসটি কাবু করতে পারে নি ৷ এজন্য এওয়ার্ড জেনার পেয়ে গেলেন গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন ৷ ফলে পৃথিবীতে প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলো এওয়ার্ড জেনারের মাধ্যমে ৷
পৃথিবীতে এরকম অনেক মরণঘাতী ভাইরাস রয়েছে করোনা ভাইরাস যার সর্বশেষ নিদর্শন
৷ এরকম অনেক ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে আবার কিছু ভাইরাসের হয়নি যেমন এইচ.আই.ভি (এইডস) ৷ লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন ৷ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মানুষের প্রয়োজনে আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছিল ব্যাকটেরিয়ানাশক অর্থাৎ পেনিসিলিন ৷
পৃথিবীতে এরকম ভাইরাসের অস্ত্বিত্ব বিলীন করা কখনো সম্ভব নয় ৷ এসব ভাইরাসের সাথেই আমাদের অবস্থান করতে হবে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা ৷ একমাত্র সচেতনতাই পারে এসব ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ৷ আসুন, নিজে সচেতন হই এবং অন্যদেরকেও সচেতন করি ৷ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনার সহিত এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করি ৷
লেখক: মোঃ রবিউল হাসান
শিক্ষার্থী, ফলিত রসায়ন ও কেমি কৌশল বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ৷
No comments