করোনা পরিস্থিতিতে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে চিনিকলে বিক্রি করা আখের বকেয়া টাকা পরিশোধের দাবি আখ চাষিদের, তাদের পাওনা প্রায় ২০ কোটি

চিত্রা নিউজ ডেস্ক-
মনোহরপুর গ্রামের আখচাষি মোঃ বদিউজ্জামান ওরফে টিটন আখ বিক্রির পাওনা ২ রাখ টাকার জন্য দিনের পর দিন ঘুরছেন মোবারকগঞ্জ চিনিকলে। কিন্তু কোনো টাকা পাননি। তার ভাষায় ফসল ফলিয়ে বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়। করোনার কারনে সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় টাকার অভাবে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ ফসল বিক্রির পাওনা টাকা পাচ্ছেন না।
আরেক কৃষক আব্দুল কাদের এর পাওনা ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তিনিও চিনিকলে ঘুরছেন টাকার জন্য। টাকা না পেলে কিভাবে চলবেন এই ভেবে সারাক্ষন পথে পথে ঘুরছেন। চিনিকলের বড় চাষী শাহজাহান আলী শেখ এর পাওনা আছে ৪ লাখ টাকা। শুধু এই দুই চাষি নন, মোবারকগঞ্জ চিনিকলের নিকট ৬ হাজারের অধিক চাষি’র প্রায় ২০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। যার সবই আখ বিক্রির টাকা। গত ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাষিরা চিনিকলে এই আখ বিক্রি করেছেন। অদ্যবদি তাদের সেই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি চিনিকল কর্তৃপক্ষ। আর সময় মতো আখ বিক্রির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় চাষিরা আখ চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন।
এদিকে এই আখ থেকে চিনি তৈরীর কাজে যে ৯ শত শ্রমিকরা-কর্মচারি নিয়োজিত, তারাও গত তিন মাস বেতন পাননি। চিনিকলের কাছে তাদের পাওনা রয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এই টাকা না পেয়ে শ্রমিক-কর্মচারিদের পরিবারে হাহাকার শুরু হয়েছে। যার জন্য গত ১৯ এপ্রিল মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ও কর্মচারি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তারা এই স্মারকলিপি প্রদান করেন বলে জানিয়েছেন ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুল।
প্রসঙ্গত, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে প্রতিষ্ঠিত মোবারকগঞ্জ চিনিকল। ১৯৬৩ সাল থেকে অদ্যবদি এই চিনিকলের কৃষকরা আখ বিক্রি করে যাচ্ছেন। ইতিপূর্বে আখচাষিদের আখের মুল্য ও শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতনের টাকা পেতে কিছুটা সমস্যা হলেও বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। চিনিকলের একটি সুত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চিনিকলের আওতাধীন ৬ হাজারের অধিক আখ চাষি রয়েছে। সদ্য শেষ করা আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষিদের নিকট থেকে ১ লাখ ৩৯ হাজার মেঃ টন আখ ক্রয় করেছেন। এই আখের মুল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর থেকে এই আখ ক্রয় শুরু করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। শেষ হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে ৩০ কোটি টাকা চাষিদের পরিশোধ করা হয়েছে। এখনও চাষিদের ১৯ কোটি ২২ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ কঠোর পরিশ্রম করে তারা জমিতে ফসল (আখ) ফলিয়ে থাকেন। সেই ফসল চিনিকলে বিক্রি করেন। কিন্তু তাদের সময়মতো টাকা দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস টাকার জন্য ঘুরে তারা আখ চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেক চাষি আগামীতে তারা আর আখ চাষ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জেলার শৈলকুপা উপজেলার কৃষক জয়নাল আবেদিন জানান, তারা টাকার জন্য ফসল চাষ করেন। চিনিকলের কর্মকর্তাদের অনুরোধে লাভজনক ফসল রেখে আখ চাষ করে থাকেন। কিন্তু আখ বিক্রির পর টাকা পরিশোধ নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়। দিনের পর দিন ঘুরতে হয় চিনিকলে। তিনি বলেন, অধিকাংশ চাষি লেবার দিয়ে ক্ষেত থেকে আখ কাটিয়ে থাকেন। এই আখ পরিষ্কার করে পরিবহনযোগে ক্রয় কেন্দ্রে নিতে হয়। এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। আশা থাকে আখ বিক্রির টাকা পেলে খরচের টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ সময়মতো আখের টাকা না দেওয়ায় তারা সমস্যায় পড়ে যান। যারা তাদের নিকট টাকা পাবেন তারা প্রায়ই নানা কথা শুনিয়ে দেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের চাষি মোঃ বদিউজ্জামান জানান, তিনি টাকার জন্য ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। গত বছর ৯ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। এবারও ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। এখন বুঝচ্ছেন এটা ভুল হয়েছে। তিনি আরো বলেন, তার ক্ষেতে যে শ্রমিকরা কাজ করেছেন তারাই এখনও ৩২ হাজার টাকা পাবেন। তিনি চিনিকলের কাছে ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা পাবেন। এই টাকা পেলে তার কোনো কষ্ট থাকতো না। তার ভাষায় করোনার কারনে সকল কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে কোনো টাকাও নেই। সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সেখানে পাওনা টাকা পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে মোবারকগঞ্জ চিনিকল আখ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাছুদুর রহমান জানান, দেশের এই পরিস্থিতিতে আখ চাষিরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ তাদের উৎপাদিত ফসল আখ বিক্রির অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। যে টাকা পেলে তাদের এই কষ্ট দূর হবে। তিনি আরো বলেন সরকারের নানা প্রনোদনা রয়েছে। তারা আখ চাষিদের পাওনার টাকার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তিনি আরো বলেন, এভাবে চাষিদের টাকা দিতে বিলম্ব করলে চাষিরা আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সেটা হলে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে। যা সকলের জন্য খারাপ খবর বয়ে আনবে।
এ বিষয়ে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মহা-ব্যবস্থাপক আনোয়ার কবির জানান, আগামী শুক্রবার তারা প্রায় ৩৫ লাখ টাকা কৃষকদের দেবেন বলে আশা করছেন। এই টাকা চিনি বিক্রি থেকে তারা উপার্যন করেছেন। তিনি আরো জানান, বর্তমানে চিনিকলের গুদামে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মুল্যের ৪ হাজার ৯ শত মেঃ টন চিনি বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। এই চিনি বিক্রি হলে চাষি ও শ্রমিক কর্মচারিদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব। বিক্রি না হওয়ায় এই বকেয়া বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.