মহামারী এই করোনা থেকে শেখার কি কিছু নেই?


 এম এ কবীর, (সাংবাদিক)
এক.
করোনা প্রভাবিত এই দুর্যোগ সময়ে ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হচ্ছেন সবাই। প্রতিরোধের নিয়মটাই এমন। গণজমায়েত এড়িয়ে গৃহে অবস্থান। উৎসবমুখর, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সামাজিক সব অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে ‘দূরত্ব বজায়’ রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। ব্যাকফুটে গিয়ে আপাতত বাঁচার এটাই উত্তম পন্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সে কথাই বলছে। যান্ত্রিক সময়ের ব্যস্ত সব মানুষরা এখন ঘরবন্দি। জীবনাচারে এসেছে অনেক পরিবর্তন। চিরচেনা দৃশ্যপট বদলে গেছে। এসেছে পরিবর্তন সামাজিক, অর্থনৈতিক সবকিছুতেই ।
দুই.
বিখ্যাত কবি
সুনির্মল বসু
‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতায়
লিখেছেন ---
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল

উদার হতে ভাই রে,

কর্মী হবার মন্ত্র আমি

বায়ুর কাছে পাই রে।

পাহাড় শিখায় তাহার সমান-

হই যেন ভাই মৌন-মহান,

খোলা মাঠের উপদেশে-

দিল-খোলা হই তাই রে।

সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়

আপন তেজে জ্বলতে,

চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,

মধুর কথা বলতে।

ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-

অন্তর হোক রতœ-আকর;

নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম

আপন বেগে চলতে।

মাটির কাছে সহিষ্ণুতা

পেলাম আমি শিক্ষা,

আপন কাজে কঠোর হতে

পাষান দিল দীক্ষা।

ঝরনা তাহার সহজ গানে,

গান জাগাল আমার প্রাণে;

শ্যাম বনানী সরসতা

আমায় দিল ভিক্ষা।

বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,

সবার আমি ছাত্র,

নানান ভাবে নতুন জিনিস

শিখছি দিবারাত্র।

এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,

পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়

শিখছি সে সব কৌতূহলে,

নেই দ্বিধা লেশমাত্র।

তিন.
মহামারী এই করোনা থেকে কি শেখার কিছু নেই ? প্রতিটি দেশ, সমাজ ও প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের মতো করে এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। কিন্তু একজন ঈমানদার এর থেকে কী শিখতে পারে – আমরা জেনে নিতে পারি এভাবে--
করোনাভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে জীবনের ক্ষুদ্রতা ও ক্ষয়িষ্ণুতা। আমাদের সামনে এই জীবন্ত সত্য তুলে ধরেছে যে মিছে এই জীবন, রংধনুর সাতরং।
দুনিয়ার জীবন দেখতে খুবই সুন্দর। দুনিয়াপ্রেমী সে সৌন্দর্য হৃদয় দিয়ে অবলোকন করে। ফলে সে এ জীবনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। মনে করে, সে নিজেই জীবনের মালিক! আকস্মিকভাবে সুন্দর জীবন তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। তৈরি করা হয় তার ও জীবনের মাঝে সুবিশাল অভেদ্য প্রাচীর। মহান আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে ক্ষুদ্রতা এভাবে তুলে ধরেছেন : পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত বৃষ্টির মতো, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি, অতঃপর তা দিয়ে জমিনে উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, আর মানুষ ও জীবজন্তু তা আহার করে থাকে। তারপর ভূমি যখন শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয় এবং এর (জমিনের) মালিকরা মনে করে এসব তাদের আয়ত্তাধীন, তখন রাতে বা দিনে আমার নির্দেশ এসে পড়ে। তারপর আমি তা এমনভাবে নির্মূল করে দিই, যেন গতকালও তার অস্তিত্ব ছিল না।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ২৪)
চার.
করোনাভাইরাস আমাদের শিখিয়েছে, মানুষ শিল্পে, শিক্ষায়, শক্তিতে, সমরাস্ত্রে, বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন, সব কিছু মহান আল্লাহর অসীম কুদরতের সামনে তুচ্ছ, তুচ্ছ এবং তুচ্ছ।
ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আকাশ এবং সেগুলোর অনুরূপ পৃথিবীও। এগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ, যাতে তারা বুঝতে পারে যে আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সব কিছু পরিবেষ্টন করে আছেন।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ১২)

পাঁচ.
করোনাভাইরাস থেকে বেঁচে থাকার জন্য যেভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয়, তেমনি সামাজিক অপরাধ যথা খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি এবং কুফর, শিরক, বেদআত সহ পাপের ভাইরাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে ‘ হোম কোয়ারেন্টিনে’ রাখতে হবে। অতীতে এর সর্বোত্তম নজির দেখা যায় আসহাবে কাহাফের ঘটনায়----
একদল যুবক নিজের ঈমান ও বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে এক দীর্ঘ ঘুমে তাঁরা ৩০৯ বছর পার করেছেন। বলা যায়, এটি ছিল দীর্ঘতম ‘ হোম কোয়ারেন্টিন’। তাঁদের ঘটনা নিয়ে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা নাজিল হয়েছে। সুরাটির নাম হলো সুরা কাহাফ।

ছয়.
মৃত্যু মানবজীবনের অনিবার্য নিয়তি ও পরিণতি। জীবমাত্র মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে এ সত্য অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই। আর করোনাভাইরাস এই নির্মম সত্যকে আমাদের সামনে আরো জীবন্ত, আরো অনিবার্য করে তুলেছে যে, যেকোনো সময় আমার মৃত্যু হতে পারে। তাই মৃত্যুর জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকা উচিত। অসিয়তনামা লিখে রাখা সুন্নত। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে রাখা চাই। নিজের সব কাজ স্বচ্ছ ও পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন।
ইরশাদ হয়েছে, ‘ বলে দাও, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়ন করো, সেই মৃত্যু তোমাদের সঙ্গে অবশ্যই সাক্ষাৎ করবে।’ (সুরা : জুমুআ, আয়াত : ৮)

সাত.
করোনাভাইরাস মুসলমানদের অজুর ইহলৌকিক উপকার চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে। অজু অন্যতম ইবাদত। পরকালে অজুর অঙ্গগুলো দীপ্তমান হয়ে উঠবে এ কথা হাদিসে আছে। কিন্তু এই ভাইরাসের সময় যেভাবে হাত ধোয়ার প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে, তাতে অজুর ইহলৌকিক উপকারিতার কথা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। দেখুন, একজন মুসলমান প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচবার অজু করে। প্রতিবার অজুতে তিনবার করে হাত কব্জি পর্যন্ত এবং তিনবার করে কনুই পর্যন্ত ধৌত করতে হয়। এতে প্রতি অজুতে ছয়বার হাত ধৌত করতে হয়। আর দিনে পাঁচবার অজু করা হলে মোট ৩০ বার হাত ধৌত করতে হয়। আর এভাবে হাত ধৌত করতে পদ্ধতিগতভাবে মুসলমানদের ইসলামী শরিয়াতের পক্ষ থেকে ‘ বাধ্য’ করা হয়েছে।
আবার রাতে ঘুমানোর আগে অজু করার নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে ছয়বার হাত ধৌত করতে হয়। আর ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুত নামাজের জন্য অজু করতে হয়। সেখানে ছয়বার হাত ধৌত করতে হয়।
ফরজ ও নফল নামাজের বাইরে সব সময় অজুর সঙ্গে থাকা মুস্তাহাব। আর একজন মানুষ প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচবার প্রাকৃতিক কাজ সারে। এ ছাড়া নানা কারণে অজু ভেঙে যেতে পারে। সব মিলিয়ে যদি আরো পাঁচবার অজু করা হয়, তাহলে কমপক্ষে ১২ বার অজু করা হয়। তাহলে একজন মুসলমান যথাযথভাবে ইসলামের বিধান মেনে চললে তাকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭২ বার হাত ধৌত করতে হয়।
তা ছাড়া খাবার গ্রহণের আগে, মিসওয়াক করার আগে, ঘুম থেকে ওঠার পর হাত ধৌত করা সুন্নত। আর হ্যাঁ, যে ব্যক্তি এভাবে হাত ধৌত করে, সে আল্লাহর ইচ্ছায় বহু ভাইরাস ও জীবাণু থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

আট.
করোনাভাইরাস আমাদের পরকালের নির্মম বাস্তবতা শিখিয়েছে। পরকালে সন্তান তার মা-বাবাকে, বন্ধু তার বন্ধুকে ভুলে যাবে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর এই ভাইরাসও দূরে যাওয়া ও দূরে থাকার সর্বাত্মক নির্দেশনা দেয়। এর সঙ্গে কোরআনের এই আয়াতগুলো মিলিয়ে দেখুন : ‘ সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভাই থেকে, এবং তার মা-বাবা থেকে, তার স্ত্রী ও সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের হবে এমন গুরুতর অবস্থা, যা তাদের নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।’ (সুরা : আবাসা, আয়াত : ৩৪-৩৭)

নয়.
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য মাস্ক ব্যবহারে জোর দেয়া হয়। এই মাস্ক থেকে মুসলিম নারী ও পুরুষের জন্য শিক্ষার উপাদান আছে। নারীরা শিখতে পারে যে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যেভাবে মাস্ক পরা হয়, ব্যাভিচার ও অশ্লীলতার মতো সামাজিক ভাইরাসরোধে পর্দার বিকল্প নেই।
আর পুরুষরা এই মাস্ক থেকে এটা শিখতে পারে যে যেখানে-সেখানে মুখের ব্যবহার করা যাবে না। মুখের লাগামহীন ব্যবহার নিষিদ্ধ।

দশ.
বর্তমানে কাশির শিষ্টাচার বলে একটা কথা প্রচলিত হয়েছে। ইউরোপ ও আধুনিক শিক্ষিত লোকেরা হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার বলতে ‘ স্যরি, এক্সকিউজ মি’ ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত ছিল। কিন্তু মুখে হাত দেয়ার বিষয়ে পনেরো‘শ বছর আগে মহানবী (সা.) শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হাই-হাঁচি দিলে মুখে হাত দেবে। পানি খাওয়ার সময় মুখ পানি থেকে দূরে সরিয়ে শ্বাস নেবে।

এগার.
করোনাভাইরাস মুসলমানদের মধ্যে নতুনভাবে এই চিন্তার উদ্রেক করে যে অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থ্যতার সময়কে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা জরুরি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,‘এমন দুটি নিয়ামত আছে, যে নিয়ামতের বিষয়ে মানুষ ধোঁকার মধ্যে থাকে। তা হচ্ছে, সুস্থ্যতা আর অবসর।’ (বুখারি, হাদিস নং : ৬৪১২)

বার.
করোনাভাইরাস সহ প্রতিবছর যেসব বিপদ ও বিপর্যয় নেমে আসে, তা মুসলমানদের তাওবা করতে উদ্বুদ্ধ করে, নিজেকে শুধরে নিতে ও সতর্ক হতে নির্দেশ দেয়।

ইরশাদ হয়েছে,
‘ তারা কি দেখে না যে তাদের প্রতিবছর একবার বা দুইবার বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয় ? এরপরও তারা তাওবা করে না, উপদেশ গ্রহণ করে না! (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৬)

তের.
কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন---

“তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো

‘এই আকাশ আমার’

কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবেনা।

সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,

‘ফুল তুই আমার’

তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে,

তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোৎস্না আমার’

কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর।”

চৌদ্দ.
সচেতন হোন, নিজে সাবধান থাকুন, অন্যকে সাবধান থাকতে বলুন। কাজে চিন্তায় আচরণে মানবিক হোন। মনে রাখবেন মানবিকতাই আপনার মনে শান্তির বারি বর্ষণ করতে পারে। অর্থ নয়, বিত্ত নয়, ক্ষমতা নয়। করোনা দিনে প্রার্থনা করি আর যেন কেউ নতুন করে আক্রান্ত না হন, প্রার্থনা করি রোগমুক্ত নতুন দিনের।

এম এ কবীর
সাংবাদিক
trynew70@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.