দুঃখের রাত সহজে শেষ হয় না -----এম এ কবীর

এম এ কবীর-
এক দেশে ছিলো এক রাজা । সেই রাজা বনে বনে শিকার করতে পছন্দ করতেন । একদিন রাজা বের হলেন হরিণ শিকারে। পথে দেখা হলো এক রাখালের সাথে। রাজাকে অসময়ে বের হতে দেখে রাখাল একটু থামল। তারপর জানতে চাইল, রাজামশাই, আপনি কোথায় যাবেন এই অসময়ে ? রাজা বললেন, হরিণ শিকারে যাচ্ছি।
রাখাল বালক রাজাকে বলল, রাজামশাই, এখন শিকারে যাবেননা। রাজা বললেন, কেন যাব না ? রাখাল বলল, আজ আবহাওয়া ভালো না । একটু পরই বৃষ্টি নামবে। রাজা আশ্চর্য হলেন রাখালের কথায়। রাজ্যের প্রধান আবহাওয়াবিদ ও মন্ত্রী রাজাকে বলেছেন আজ আকাশ ঝঁকঝঁকে রোদ থাকবে। কোথাকার কোন রাখাল কী বললো তাতে কিছু আসে যায় না। রাজা গুরুত্ব দিলেন না রাখালের কথায়। তিনি জঙ্গলের দিকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। রাজা সেদিন ছাতা নিয়েও বের হননি। ভিজতে হলো। ভিজতে ভিজতে রাজা বাড়ি ফিরলেন ভয়ানক অবস্থায়।
রাজসভার সবাইকে গালাগাল করলেন রাজাকে ছাতা না দেয়ার জন্য। এর কিছুদিন পর রাজা সেই রাখালকে ডাকলেন রাজদরবারে। রাখাল করজোড়ে বলল, রাজামশাই, আমি কি কোনো ভুল করেছি? যদি করে থাকি ক্ষমা করে দিন। আমার বউ-বাচ্চা আছে। রাজা বললেন, ভুল করোনি। তুমি শুধু বল কী করে সেদিন আমাকে আবহাওয়ার আগাম খবর দিলে?
এভাবে আগাম খবর দেয়ায় আমি আজ তোমাকে প্রধান আবহাওয়াবিদ করে দিলাম। আবহাওয়াবিদ কী জিনিস তার কিছুই জানে না রাখাল। তাই ভয়ে ভয়ে বলল - হুজুর! সেদিন বৃষ্টির আগাম খবর দেয়ার কৃতিত্ব আমার না। আমার ছাগলের।
রাজা বললেন, সেটা আবার কেমন কথা ? রাখাল বলল, বৃষ্টি আসার আগে আমার ছাগলের দল সব সময় চোনায়ে (প্র¯্রাব) দেয়। তাই দেখে আমি বুঝি বৃষ্টি আসছে। সেদিন আপনি শিকারে যাওয়ার মুহূর্তে দেখলাম ছাগল চোনাচ্ছে। তাই সাহস করে আপনাকে বলেছিলাম, বৃষ্টি আসার সময়ে আপনার শিকারে যাওয়া ঠিক হবে না। আসলে আগাম আবহাওয়ার খবর দেয়ার মূল কৃতিত্ব আমার ছাগলের। রাজা এ কথায় আরও খুশি হলেন। আসল সংবাদদাতাকে পাওয়া গেছে। বিলম্ব করলেন না রাজামশাই। সঙ্গে সঙ্গে ছাগলকে বসিয়ে দিলেন আবহাওয়া মন্ত্রণালয়ে। আর রাখালকে বানালেন প্রধান আবহাওয়া কর্মকর্তা।
জানি, আজ চারদিকে সবাই ভীষণ বিপদে। হঠাৎ কেন যেন এই গল্পটা মনে পড়ে গেল। মনটা আসলে ভালো নেই। বিষণœতা পেয়ে বসেছে আমাকেও। এই খারাপ সময়ে কিছু মানুষের কু-কীর্তিতে মন খারাপ হয়ে যায়। বেদনায় ছুঁয়ে যায় মন। আমরা বের হতে পারছি না নিষ্ঠুর মানসিকতা থেকে।
সর্বগ্রাসী করোনা কেবল মানুষের প্রাণহরণই করছে না, পাল্টে দিচ্ছে মানুষের যুগযুগান্তরের বিশ্বাস, রুচি-অভ্যাস. স্বভাব-প্রবৃত্তি এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন। আদিম অন্ধকার থেকে ওঠে আসা আণুবীক্ষণিক দানব কোভিট-১৯ আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটার খোলনলচে পাল্টে দিচ্ছে। মাত্র তিন মাসে আমাদের চেনা পৃথিবীটা কেমন অচেনা অমানবিক হয়ে গেছে।
আমাদের এই শহরে রাস্তার ধারে লাশ পড়ে থাকে। আবেগপ্রবণ পরোপকারী মানুষেরা আ-হারে বলে হামলে না পড়ে আতঙ্কে দূরে সরে যাচ্ছে। নিথর দেহে স্পন্দন আছে কিনা দেখতে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। মুখটা ঢেকে দিচ্ছে না-- এমন ঘটনা অভাবনীয় অ্যাবসার্ড।
ধর্মীয় অনুশাসনে ইসলামের সূতিকাগার সৌদির চেয়েও একধাপ কঠোর ইরান। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে মদপান নিষিদ্ধ। ইসলামে এটি হারাম। ইরানের ইসলামী দন্ডবিধির ২৬৫ ধারা অনুযায়ী দেশটির কোনো নাগরিক মদপান করলে শাস্তি হলো ৮০ টি দোররা। ওই কঠোরতাকে ফসকা গেরো বানিয়ে ছাড়লো করোনাভাইরাস। মদ পান করলে দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয় না, এমন একটি গুজবে কান দিয়ে ধর্মপ্রাণ ইরানিরা পুরুষ-নারী জোয়ান-বুড়ো নির্বিশেষে মদ্য পানে হামলে পড়লো। ভাইরাস পয়জনিংয়ে নয়, ৬শত মানুষ মারা গেল মদপানের বিষক্রিয়ায়। কেয়ামত নাজিল না হলেও ইরানে মদের এতটা কদর হবে, কে ভেবেছিল!
যুক্তরাজ্যের অনেক মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, ব্রিটিশ স¤্রাজ্যই বিশ্বে আধুনিক সভ্যতার পত্তন করেছে। ওই দাবি বাদ দেয়া যাক, ব্রিটেনের মানুষকে বিশ্ববাসী বাস্তববাদী বলেই জানে। দেশটির মার্জিত মনোভাবের অধিকারী মানুষের যুক্তি নির্ভরতা করোনার কবলে ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এই মহামারিতে ব্রিটিশরা গুজবে প্রভাবিত হচ্ছে। কেবল তাই নয়, গুজবে কান দিয়ে তারা হয়ে ওঠছে মারমুখি। করোনাভাইরাসের বিস্তৃতির সঙ্গে ইন্টারনেটের ফাইভ-জির সম্পর্ক আছে, এই অযৌক্তিক তথ্যে বিশ্বাস করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্যে। দেশটির উত্তেজিত জনতা বেশ কয়েকটি ফাইভ-জি মোবাইল ফোন টাওয়ার ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
বেওয়ারিশ লাশের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম, মৃত বাবার মরদেহ জড়িয়ে ধরে সন্তান কাঁদবে না, মৃত্যুর আগে স্বামী প্রিয়তমা স্ত্রীর হাতের পানি পান থেকে বঞ্চিত হবে, হৃদপিন্ডের টুকরোর চেয়ে দামি শিশুটার নিথর দেহ বুকে জড়িয়ে ধরতে জনক-জননী ভয় পাবে... হে মাবুদ এ কোন অভিশাপ ছুঁড়ে দিলে আমাদের সবুজ পৃথিবীতে!
সলিল চৌধুরী লিখেছেন---
‘ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রি এখানে থেমো না
এ বালুর চরে আশার তরণি যেন বেঁধো না’।
আল্লাহ বিপদ দেন, আবার উদ্ধারও করেন। আর উদ্ধার করেন বলেই মানবজাতি টিকে আছে। ছোটবেলায় মাঝরাতে অসুস্থ হলে মনে হতো এই রাত শেষ হচ্ছে না কেন? মা বলতেন, বাবা! একটু ধৈর্য ধর, অন্ধকারের পরই আলো আসবে। সূর্য উঠবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কাছে মনে হতো, অন্ধকার রাতের কোনো শেষ নেই। দুঃখের রাতগুলো সহজে শেষ হয় না।
অনেক আত্মীয়ের মৃত্যুর রাতে পাশে ছিলাম। দেখতাম সেই রাত শেষ হতে চাইত না। একটু আলোর জন্য আকুতি নিয়ে অপেক্ষা করতাম। সে অপেক্ষা শেষ হতো না। বিশ্বাস ছিল, একসময় অন্ধকার কাটবেই। ভোরের আলো ফুটবেই। এখনো বিশ্বাস করি, এ পথিবী একদিন স্বাভাবিক হবে। কেটে যাবে সব সংকট, মানুষের এই দুঃখ-কষ্ট। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের দূরে সরাবে।
হয়তো তত দিনে বদলে যাবে অনেক কিছু। পরিবর্তন আসবে বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে। আমরা হয়তো হারাব আমাদের অনেক প্রিয়জনকে। তত দিনে নিজেরাও থাকব কিনা জানি না। হয়তো এ লেখাও হতে পারে শেষ লেখা আমার কিংবা আপনার জন্য। তবু বলছি, আবার পূর্বদিগন্তে লাল সূর্য ছড়াবে আলোকরশ্মি। নতুন সূর্যের আলো দেখতে চাইলে আমাদের সতর্ক হতে হবে।

এম এ কবীর
সাংবাদিক



No comments

Powered by Blogger.