সরকারি হিসাবে ৮ দখলদারের আছে ৮ টি পুকুর, বাস্তবে অসংখ্য পুকুর আর ভবনে সংকুচিত হয়ে গেছে চিত্রা নদী

স্টাফ রিপোর্টার-
চিত্রা নদী ঝিনাইদহ অংশে পুকুর আছে ৮ টি, এক গ্রামের ৮ দখলদার দীর্ঘ দিন পুকুরগুলো কেটে সেখানে মাছের চাষ করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসনের তালিকায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। অবশ্য এই নদীর ঝিনাইদহ অংশের ৪৩ কিলোমিটারে আরো বেশ কিছু দখলদার রয়েছেন। নদীর মধ্যে যাদের পুকুর, বাগান এমনকি বাড়িঘরও রয়েছে। যা তালিকায় পাওয়া যায় নি।
অবশ্য চিত্রা বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা বলছেন, এটা হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। এই নদীর জায়গা দখল করে বাড়িঘর নির্মান করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে নদীর মধ্যে। বড় বড় গাছ জন্মেছে এই চিত্রার বুকে। যেগুলো অপসারন এর দাবিতে তারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সেগুলো তালিকায় নেই এটা জানতে পেরে তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

প্রসঙ্গত, ঝিনাইদহ জেলার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। এই নদীটি চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনার নিম্নস্থল থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঝিনাইদহে প্রবেশ করেছে। নদীটি আরো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ হয়ে মাগুরার শালিখা হয়ে নবগঙ্গায় মিশেছে। ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটির ঝিনাইদহ অংশ রয়েছে প্রায় ৪৩ কিলোমিটার। এক সময় এই নদীতে লঞ্চ-স্টিমার সবই চলতো। ব্যবসায়ীদের পন্য পরিবহনে নদী ব্যবহার হতো। নদীর ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠে কালীগঞ্জ শহরটি। বর্তমানে নদীটি দখল হয়ে সংকুচিত হয়ে গেছে।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী দখলের পৃথক তালিকা তৈরী করেছেন। যেখানে কালীগঞ্জ উপজেলার সিংদহ গ্রামের ৮ ব্যক্তি নদীতে ৮ টি পুকুর করেছেন উল্লেখ করা হয়েছে। দখলদার হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তারা হচ্ছেন সিংদহ গ্রামের মতিয়ার রহমান, ইসাহক আলী, সিরাজুল ইসলাম, লিয়াকত আলী, মিজানুর রহমান, মফিজ উদ্দিন, আফসার আলী ও মোঃ আব্দুল। এরা সকলেই নদীর মধ্যে পুকুর কেটেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরেজমিনে সিংদহ গ্রামে গিয়ে দখলদার ওই ৮ জনের কাটা ৮ টি পুকুর পাওয়া যায়। যেগুলো অনেক পুরানো। কোনো কোনো পুকুরের পাড়ে লম্বা লম্বা নারিকেল গাছও রয়েছে।
এদিকে নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কালীগঞ্জের চাঁচড়া এলাকা থেকে শালিখা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটারে নদীর দুইপাড় অসংখ্য দখলদার রয়েছে। এখানে নদীর জায়গায় পুকুর কেটে মাছ চাষ করা হচ্ছে। নদী ভরাট করে নার্সারী প্রতিষ্ঠাও করেছেন দখলদাররা। মার্কেট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে এই নদীর মধ্যেই। দখলের কারনে নদীটি খালে পরিনত হয়েছে। স্থানিয় ভাবে প্রভাবশালী তারাই এই দখল করেছেন।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের মেইন বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে চিত্রা নদীর ব্রীজ সংলগ্ন নির্মান শুরু হয়েছিল একটি বিশাল পাঁকা ভবন। যেটা আপাতত বন্ধ আছে। এরই কিছুটা পশ্চিমে শিবনগর গ্রামের নিচে জনৈক মুক্তার হোসেন নদীর জায়গায় ঘর তৈরী করে মুরগীর ফার্ম করেছেন। শহরের মধ্যে নদীর উপর থাকা সেতুটির (পুরাতন সেতু) দুইপাশে মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেতুর পশ্চিমে নদীর দুইপাড়ে যেভাবে বড় বড় পাঁকা ভবন তৈরী হয়েছে, এখন দেখে বোঝার উপায় নেই এটা নদী, না খাল। সেতুর পূর্ব পাশেও দুইপাড়ে অসংখ্য পাঁকা ভবন। এক শ্রেণীর লোকজন নানা কাগজপত্র দেখিয়ে এই সকল জায়গাটি তাদের দাবি করে আসছেন। কিন্তু প্রবীন ব্যক্তিদের ভাষায় এগুলো সবই এক সময়ে নদীই ছিল। শহরের কালীবাড়িটির কিছু অংশ নেমে গেছে নদীর মধ্যেই। সেখানেও দখল হয়েছে নদীর জায়গা। হেলাই হাসপাতালের নিচে নদীর মধ্যে বিশাল বড় পুকুর কাটা হয়েছে। এই পুকুরের পাড়ে বিশাল বিশাল গাছ রয়েছে। যেগুলো নদীর পানির গতিপথই নয়, গোটা নদীটিই আড়াল করে দিয়েছে। নিশ্চিন্তপুর এলাকার নদীর মধ্যে ঈদগাহনির্মান করা হয়েছে।
শুধু দখলনয়, নদীতে নানা ধরনের ময়লা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। ক্লিনিকের বর্জ্য, শহরের ময়লা ফেলে পানি দুষণ করা হচ্ছে। কুকুর-বিড়াল মারা যাওয়ার পরও বস্তায় ভরে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি দুষিত হচ্ছে।
নদীর জায়গায় মুরগীর ফার্ম নিমানের সঙ্গে যুক্ত মুক্তার হোসেনের দাবি এটা তারই জায়গা। তিনি বেশ কয়েক বছর পূর্বে ঘরটি নির্মান করেছেন। নিশ্চিন্তপুর এলাকার নিচে নদীর মাঝে পুকুর রয়েছে কালীগঞ্জ শহরের বাসিন্দা তারিকুর রহমানের। তিনি অবশ্য জানান, নদীর উপর তাদের জমি রয়েছে। সেখানে পাড় ঘেষে পুকুর তৈরী করেছেন। নদীর মধ্যে পুকুরের কিছু অংশ যেতে পারে। হেলাই গ্রামের নিচে নদীর অপর পাড় দখল করে ঈদগাহ নির্মান করা হয়েছে। যে স্থানে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর পূর্বেও নদীর শ্রোতছিল।
এই দখল প্রসঙ্গে চিত্রা বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক কালীগঞ্জ শহরের বাসিন্দা শিবুপদ বিশ্বাস জানান, দখলের পর দখল হয়েছে চিত্রা নদী। সেখানে মাত্র ৮ টি পুকুর তালিকায় এসেছে। এটাতে মূল দখলদাররা ধরার বাইরে থেকে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। তিনি বলেন, চিত্রাকে বাঁচাতে হলে সকল দখলদারের নাম তালিকায় আসতে হবে। দখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করতে হবে। এরপর নদী খনন করতে হবে। তাহলেই চিত্রা নদীটি বাঁচানো যাবে। যার জন্য তারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
এই তালিকার বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাজিয়া আক্তার চৌধুরী জানান, তিনি অল্পদিন এই জেলাতে যোগদান করেছেন। যে কারনে তালিকা নিয়ে বিস্তারিত কিছুই তার জানা নেই। তালিকা একটা হয়েছে এটাই শুধু জানেন। আর ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার ভুমি অফিসের তথ্য নিয়ে এই তালিকা করেছেন। আরো দখলদার থাকলেও তাদের তালিকায় নাম আনতে পারেননি।

No comments

Powered by Blogger.