মুসলমানদের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন 'শহর মোহাম্মাদাবাদ' এ আমাদের একদিন

তরিকুল ইসলামঃ
শহর মোহাম্মাদাবাদ ঝিনাইদহ জেলার কালীগন্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়ন এ অবস্থিত ৷ঝিনাইদহ শহর থেকে ২৬কিলোমিটার দূরবর্তী যেখানে মুসলমানদের ৭০০বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনের পুরাকীর্তি রয়েছে৷ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকোশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরিচালিত 'উদ্ভাস ইনভেস্টিগেটর টিম' এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক গত ১৫ ফেব্রুয়ারি,২০১৯ইং আমরা যাই এই প্রাচীন নিদর্শনসমূহের ইতিহাস -ঐতিহ্য সন্ধানে৷এই পর্বে টিমের ছয়জন সদস্য অংশ নেয় ( নরসিংদীর রাহিত, চাপাইনবাবগন্জের আহাদ, নাটোরের নিজাম, মেহেরপুরের আলিমুল মামুন, কুষ্টিয়ার কুতুব আর ঝিনাইদহ থেকে আমি তরিকুল)৷
দিনটি ছিল শুক্রবার৷ আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কুষ্টিয়া থেকে সবাই রওয়ানা দিল সকাল আটটার ক্যাম্পাসের বাসে৷ সাড়ে নয়টায় ঝিনাইদহ শহরে এসে পৌঁছায় ওরা৷আমি তাদের রিসিভ করে শহরের একটা রেস্টুরেন্ট এ সকালের নাস্তা সেরে রওয়ানা দিলাম বারবাজারের পথে৷ শিক্ষা সফরের মৌসুম হওয়ায় সড়কে বাস কম ছিল৷ তাই ঝিনাইদহ থেকে সিএনজিতে চড়ে রওয়ানা দিলাম৷ কালীগন্জ পৌঁছে পুনরায় অন্য সিএনজিতে চড়ে বারবাজার পৌঁছাই ৷ ঝিনাইদহ থেকে বারবাজার প্রতিজনের খরচ পড়বে ৩০-৪০টাকা৷তারপর একটি ভ্যান রিজার্ভ করে আমরা নিদর্শনগুলি দেখতে যাই৷

বারবাজারের ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শনগূলি প্রায় ৭০০বছরের পুরানো৷১৯৯৩ইং সালে এই নিদর্শনগূলি মাটি খুঁড়ে বের করা হয়৷বারবাজার রেল লাইনের পশ্চিম পাশে তিন কিলোমিটার জায়গা জুড়ে মসজিদসহ ১৫টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সন্ধান মিলেছে৷এসব নিদর্শনসমূহ হল সাতগাছিয়া মসজিদ, ঘোপের দিঘি কবরস্থান, নামাজগাহ কবরস্থান , গলাকাটা মসজিদ, জাহাজঘাটা, দমদম প্রত্নতত্ত্ব , গোড়ার মসজিদ, জোড় বাংলা মসজিদ, মনোহর মসজিদ, পীরপুকুর মসজিদ, শূকুর মল্লিক মসজিদ, নুনগোলা মসজিদ, খড়ের দীঘি কবরস্থান, পাঠাগার মসজিদ ও বাদেডিহি কবরস্থান৷ এর মধ্যে জোড় বাংলা মসজিদ খননের সময় একটি শিলালিপি পাওয়া যায়, তাতে লেখা ছিল শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে পুসাইন ৮০০ হিজরি৷ এ থেকে বোঝা যায় এসব মসজিদ প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন৷আর বেশিরভাগ নিদর্শনের পাশে বড় বড় দিঘী রয়েছে৷ প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ এই নিদর্শনের নাম দিয়েছে 'শহর মোহাম্মাদাবাদ'৷ 
আমরা ভ্যানযোগে প্রথমেই যাই গোরার মসজিদে৷ এই মসজিদের গেটে লেখা আছে ঐতিহ্যবাহী গোরার মসজিদ৷সড়ক থেকে সরু পথ দিয়ে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে চার গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি৷ মসজিদের চারকোণা ও বারান্দা মিলিয়ে মোট দশটি স্তম্ভ বিদ্যমান৷ ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে মসজিদটির মেহরাব ও দেয়াল বিভিন্ন নকশায় সজ্জিত৷ দেয়ালগূলিতে পোড়ামাটির নকশা চোখে পড়বে ৷ মসজিদের পূর্বপাশে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে৷ 
তারপর আমরা যাই গলাকাটা মসজিদের দিকে৷ বারবাজার- তাহেরপুর সড়কের উত্তর পাশে অবস্থিত এই মসজিদটি সুলতানী আমলের কীর্তি৷ গোলাকার ঢিবির উপর নির্মিত মসজিদটির ভেতরের দিকের কেবলা ও দেয়ালে তিনটি অর্ধচন্দ্রাকৃতির সুসজ্জিত মেহরাব আছে৷ এখানে দেখা মিলবে পোড়ামাটির নকশা আর পোড়ামাটির ঘন্টা৷মসজিদের উত্তরে রয়েছে বিশাল দিঘী৷ সামনে রাস্তার পাশেই সাইন বোর্ডে 'শহর মোহাম্মাদাবাদ' এর মানচিত্রে সবগূলি নিদর্শন চিহ্নিত করা আছে৷ এখান থেকে ধারণা নিয়ে আমরা যাই জোড় বাংলা মসজিদ, পীর পুকুর মসজিদ, শুকুর মল্লিক মসজিদ, নুনগোলা মসজিদ ও পাঠাগার মসজিদে৷ 
আপনি চাইলে যেকোন সময় যেতে পারেন এই নিদর্শনগূলি দেখতে৷ তবে শুক্রবার নামাজের আগে ও পরে সবচেয়ে ভাল সময় , কেননা সব সময় এসব মসজিদ খোলা থাকে না৷আর বারবাজারে যদি সুন্দর আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থা করা যায় তবে দেশি বিদেশী দর্শনার্থীদের নিকট এটি হতে পারে একটি ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র৷শহর মোহাম্মাদাবাদের এই তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পরিকল্পিত ভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে সংরক্ষণ করলে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও উপকৃত হবে৷ 

No comments

Powered by Blogger.