বৃদ্ধ পিতা মাতা সন্তানের কাছেও এখন আর নিরাপদ নয়। প্রয়োজনে আলাদা মন্ত্রনালয়ের দায়িতে¦ অসহায় প্রবীণদের জন্য “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তোলার দরকার।
আলহাজ্ব এম. এ. কাদের :
জাতিসংঘের আহবানে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় গুরুত্বের সংগে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়ে আসছে।মানুষের আয়ু বাড়ার সংগে সংগে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি। এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। ২০৫০ সালে প্রবীণসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মত দরকারী প্রস্তুতি আমাদের নাই।
ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছেন বাইরে থেকে সেটা বুঝা যায় না। অনেক সময় বৃদ্ধ পিতা মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ী পাহারা, সন্তান দেখাশুনা, বাজার করানো, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, ধমক দিয়ে কথা বলা, অপমান জনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, বৃদ্ধ পিতা মাতাকে আলাদা রাখা, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-জায়গা বাড়ীটুকু পর্যন্তও জোর করে লিখে নেওয়া হচ্ছে। অনেক বাবা-মা সন্তানের কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন। এমনকি মাদকাসক্ত ছেলে মেয়ে, বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে।
সামর্থ্য থাকা সত্বেও অনেকে অসুস্থ পিতা-মাতার এতটুকু খোঁজ খবর পর্যন্ত নিতে চায় না। তাছাড়া সন্তানদের ভাগাভাগির কারণে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একে অপরের কাছ থেকে আলাদ করে রাখা হয়। এই অসহায় অসুস্থ প্রবীণদেরকে সন্তান, প্রতিবেশী, সরকার, জনপ্রতিনিধি কেউই আর এতটুকু সময় দিতে চায় না। বৃদ্ধ পিতা-মাতার মধ্যে একজন মারা গেলে অন্যজন একেবারে একাকী হয়ে যান এবং আরও অসহায় হয়ে পড়েন।
অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়ীতে রেখে তালা বন্ধ করে নিয়মিত স্বামী-স্ত্রী তার কর্মস্থলে চলে যায়। অনেক সময় অনেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একাকী রুমে আটকা রেখে ৫/৭ দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে চলে যায়। তাছাড়া পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে পরিবারের সকল সদস্য অংশ গ্রহণ করলেও বৃদ্ধ পিতা মাতাকে ঝামেলা মনে করে সঙ্গে নিতে চায়না। অনেক সময় প্রবীণদের থাকার জায়গাও নিম্নমানের হয়ে থাকে। যেমন বাড়ীর বারান্দা, চিলেকোঠার খুপরীঘর, গোয়ালঘর এমনকি বাড়ীর কাজের লোকের সাথে অমানবিক ভাবে থাকতে দেওয়া হয়।
অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের এই কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। এত কষ্টের পরেও কেউ ভাল মন্দ জানতে চাইলে সন্তানের মুখ উজ্জ্বলের জন্য বলেন, “আমি খুব ভাল আছি”।
আমাদের দেশে প্রবীণ কল্যানে চলমান শিক্ষা পাঠ্যসূচি, গণমাধ্যম কর্মসূচি কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সূচিতে বার্ধক্য বিষয়ে নেই কোন সাঁড়া শব্দ। সময় থাকতে এখনই আমাদের প্রবীণদের বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া জরুরী। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সংগে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। দয়া দাক্ষিণ্য বা করুনার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা। আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযতœ, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্য সূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
যে প্রবীণ যৌবনে তাঁর মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সেই মানুষটি অযতœ অবহেলার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। আপতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের নূন্যতম দায়ীত্ব তাঁদের উপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য সরকার ও পিতা-মাতার যেমন দায়িত্ব আছে অনুরূপ ভাবে প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
এক অসহায় বৃদ্ধ মাতা তাঁর ছেলেকে উদ্দেশ্য করে কষ্টের কথা চিঠিতে লিখে বিছানার নীচে রেখে মারা যান। চিঠিটা এমন- বাবা তুমি যখন এই চিঠিটি পাবে, তখন হয়ত আমি থাকবো না। আমি জানি তুমি চিঠিঠি পেয়ে তোমার অনেক অনুশোচনা হবে, তবুও তুমি কোন কষ্ট নিও না। জান বাবা! তুমি যখন একেবারে ছোট্ট ছিলে তখন আমাদের ঘরের বারান্দায় একটি পাখি দেখে আঙুল উঁচু করে দেখিয়ে বলেছিলে মা এইটা কি! আমি হেসে হেসে উত্তর দিয়েছিলাম বাবা! এটা চড়–ই পাখি। তুমি না বুঝে বার বার একই প্রশ্ন করছিলে, এইটা কি? এটা কি? আমি প্রতিবারই হেসে হেসে উত্তর দিয়েছিলাম বাবা, এটা চড়–ই পাখি। বাবা একই উত্তর দিতে আমি একটুও বিরক্ত হইনি। কিন্তু এখন আমি কোন কিছু না বোঝার কারণে তোমাকে দু’বার জিজ্ঞাসা করলেই তুমি বিরক্ত হয়ে, ধমক দিয়ে বল; তুমি এটা চেনো না? তুমি এটা বোঝ না? তুমি ছোট বেলায় কিছু দেখলেই ভয় পেতে। আমি তখন তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আগলে রাখতাম। এই বৃদ্ধ বয়সে বাড়ির নীচ তলার এক ঘরে, একা থাকতে আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়। এবিষয়ে তোমাকে অনেক বলেছি, কিন্তু তুমি শুধু শুনেই গিয়েছো, উত্তর দাওনি। একদিন ধমক দিয়ে বলেছিলে এত ভয় কিসের? তোমার ছোট বেলায় তোমার পছন্দের খাবারগুলো তৈরী করে বার বার তোমার মুখে তুলে খাওয়াতাম। এমনকি নিজের পাতের ভালটুকু নিজে না খেয়ে, তোমার মুখে তুলে দিতাম। কিন্তু তুমি মাসে একদিনও আমার কাছে জানতে চাওনা, আমার কি খেতে ইচ্ছে করে? তোমার খুব ছোট বেলায় বার বার প্রস্রাব পায়খানার কারণে দিনে রাতে ১৫/২০ বার পরিষ্কার করে পানিতে ধুয়ে, সুগন্ধি লাগিয়ে বুকে টেনে আদর করতাম। কিন্তু তুমি সপ্তাহে একদিনও এসে জানতে চাওনা, আমার গোসল হচ্ছে কিনা। তুমি ছোট বেলায় অসুস্থ্য হলে আমাদের ঘুম হারাম করে দিতে। রাত দিন তোমার যতœ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমাকে সুস্থ্যতার জন্য প্রার্থনা করতাম। কিন্তু আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেও তুমি তো আমার তেমন খোজ খবরই নাও না। আমি জানি তুমি যখন এই চিঠি পাবে, তখন আমি হয়ত এই পৃথিবীতে থাকবো না। তোমার খুব কষ্ট হবে। তার পরেও আমার মত কষ্টের মধ্যে তোমাকে যেন পড়তে না হয়, সেইভাবে তোমার সন্তানকে তৈরী কর বাবা।
প্রবীণদের এই অসহায় দূর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে। অনেক সন্তান তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাবা-মার পরিচর্যা বা সেবা যতœ করতে পারেনা। অনেক পিতা-মাতা নিজের ভিটা মাটি ছেড়ে বিদেশে সন্তানের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। এই সব নানা কারণে দিনদিন সন্তানদের সাথে বাবা-মা’র সু-সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া অনেক পিতা-মাতার পুত্র সন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়ীতে থাকতে পছন্দ করেন না
এ থেকে পরিত্রান পাওয়ার একটাই উপায়; কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সাথে বসবাস করার জন্য “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তুলতে হবে। যেখানে স্ব-ইচ্ছায় প্রবীণরা থাকতে চাইবেন।
প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির উপরে এই “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তুলতে হবে। আনন্দ আশ্রয়ে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, থাকবে ভাল নার্সিং ব্যবস্থা, থাকবে ভাল মানের খাবার, থাকবে বিনোদনের ব্যবস্থা, থাকবে প্রার্থনার জন্য মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যয়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভাল আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যে কোন প্রবীণ স্ব-ইচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বা একা একা থাকতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। একই বয়সে অনেকে এক সাথে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকতে পারবেন। এতে সন্তান, আপন জনেরা দেশে বিদেশে যেখানে থাকুক না কেন বাবা-মা ভালো আছেন ভেবে তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান/আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে বাবা-মা’র সঙ্গ দিতে পারবেন। গরীব অসহায় প্রবীণরা সরকারী খরচে থাকবেন। প্রয়োজন হলে স্ব-ইচ্ছায় কিছুদিন বাড়ীতে, কিছুদিন “আনন্দ আশ্রয়ে” থাকতে পারবেন।
অসহায় প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তোলার জন্য নিজ দায়িত্বে সকলে এগিয়ে আসলেই সত্বর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে এই মহৎ উদ্যোগকে বেশীরভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য সমাজে দানশীল ও বিত্তবানেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। এখন সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার ও জনপ্রতিনিধিদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।
আলহাজ্ব এম.এ. কাদের (সাংবাদিক)
লেখক ও কলামিষ্ট,
কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
মোবাইলঃ ০১৭১১-৩৩৮১৮২।
লেখক ও কলামিষ্ট,
কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ
মোবাইলঃ ০১৭১১-৩৩৮১৮২।
No comments