কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নলডাঙ্গা রাজবাড়ির ৮টি সূদৃশ্য মন্দির


॥চিত্রা নিউজ ২৪ ডেক্স॥
যে রাজ্য রক্ষায় ছিল সৈন্য বাহিনী। রাজ প্রাসাদ রক্ষায় চারিদিকে খনন করা হয়েছিল পরিখা, রাজার জীবন বাঁচাতে বেগবতী নদীর সাথে তৈরী করা হয়েছিল গোপন সুড়ঙ্গ পথ, যেখানে ছিল রাজ পরিবারের সুসজ্জিত প্রাসাদ সেখানে আজ তার কিছুই নেই। সবই ধবংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্ত কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজাদের নির্মিত ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে নলডাঙ্গা রাজাদের তৈরী আটটি সুদৃশ্য মন্দির। সরেজমিনে নলডাঙ্গাতে গেলে দেখা যায়, সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদ বিলীন  হয়ে গেলেও বেগবতি নদীর ধারে বহুকাল ধরে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, গনেশ মন্দির, দূর্গা মন্দির, তারামনি মন্দির, বিঞ্চু মন্দির, রাজেশ্বরী মন্দিরসহ  সুদৃশ্য আটটি মন্দির। যে গুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে  ১৬৫৬ সালে। যার মধ্যে শ্রী শ্রী সিদ্ধেশরী মন্দিরসহ কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, তারা মন্দির, বিঞ্চু মন্দিরসহ, দ্বিতল বিশিষ্ট পাঁচটি মন্দিরের সংস্কারের কাজ  ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। স্থানীয় জন সাধারন ও জেলা পরিষদের আর্থিক সহযোগীতায় এগুলো  সংস্কার করা হলেও অন্যগুলো প্রায় ধবংসের দ্বারপ্রান্তে। স্থানীয় মন্দির সংস্কার কমিটির সাধারন সম্পাদক অতুল অধিকারী জানান, ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন থেকে ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে সরকারী বরাদ্দকৃত ৭৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয় শ্রী শ্রী লক্ষীদেবী মন্দির উন্নয়নের জন্য এবং শিব মন্দির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৬৫ হাজার টাকা। যে টাকা ব্যয় করে কিছু সংস্কারের কাজ করা হলেও বাকি কাজ স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় এগিয়ে  চলেছেন।

 তিনি আরো জানান, এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষক যে কারনে তাদের পক্ষে এত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব নয়। প্রতিদিন দূর- দুরান্ত থেকে বহু ভক্ত ও দর্শনার্থী এসে ভীড় করে । এতগুলো মন্দির পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে রয়েছে দুইজন ঝাড়ুদার, পূজা পার্বনের জন্য রয়েছে তিন জন পুরোহিত যাদের বেতন সাহায্য তুলে দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকজনেরা আরো জানান, এ মন্দিরের একটু উত্তর পাশেই রয়েছে প্রায় ৯ একরের সমান জলাকার। যেটা নিয়ন্ত্রন করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। প্রবীনদের মুখে ও ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, আজ থেকে প্রায় পাঁচশত বছর আগে এই রাজ বংশের আদি পুরুষ ভট্রনারায়ন ফরিদপুরের তেলিহাট্টি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন। তারই এক উত্তর সুরী বিঞ্চুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরী করে হাজরা উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। তিনিও নবাবের চাকরী করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিঞ্চুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার নিকট খেড়াসিং গ্রামে চলে এসে বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন। ১৫৯০ সালে মোঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকা যোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তার সৈন্যরা রসদ সংগ্রহের জন্য  বের হন। এ সময় তারা জঙ্গলের মধ্যে বিঞ্চুদাস সন্যাসী তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পান। বিঞ্চুদাস অতিথী সৈন্যদের জন্য খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে বিঞ্চুদাস সন্যাসীকে পার্শ¦বর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করে যান।

এই গ্রামগুলির সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারী এবং পরে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই এলাকাটি নলখাগড়া ও নটা উদ্ভিদে পরিপুর্ন ছিল তাই স্থানটি  নলডাঙ্গা নামেই পরিচিতি লাভ করে। এরপর প্রায় তিনশত বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক রাজ্যটি শাসন করেন। ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষন যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রমথভূষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্ব ভার গ্রহন করেন এবং তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন এ মন্দিরগুলো। লোকমুখে যতটুকু শোনা যায় রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ট পুত্র। তিনি রাজ বংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষন মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারী ভার গ্রহন করেন রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণ দেবরায় । ১৯১৩ সালে তিনি রাজা বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন।

 সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দুভূষণ ও মধূমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২ সালে রাজবাড়ির নিকট আজকের নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি শহরের প্রান কেন্দ্রে অবস্থিত এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে কালীগঞ্জ উপজেলার সর্ববৃহত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নগ ভূষণ দেবরায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেবরায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারী আদেশে অন্যান্য জমিদারীর মতো এই জমিদারীও সরকারের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। এলাকাবাসির মতে, সরকারীভাবে সংস্কার করে এ এলাকাতে একটা পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করলে একদিকে সরকারী আয়ের উৎস হবে অন্যদিকে রক্ষা হবে রাজ পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

No comments

Powered by Blogger.