‘কালীগঞ্জের আসমানীর জীবন সংগ্রাম’


স্টাফ রিপোর্টার :
“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/রহিমুদ্দিনের ছোট্ট বাড়ি রসুল পুরে যাও”।
“পল্লীকবি” জসীম উদ্দিনের অমর লেখা আসমানী কবিতায় তিনি যে আসমানীকে তুলে ধরে ছিলেন, সেই আসমানী আজ বেঁচে নেই। তবে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বৃদ্ধা শহিদা বেগম (৭০) যেন তারই প্রতিচ্ছবি। শহিদার থাকার ঘর যেন কবির কাল্পনিক আসমানীদের ঘরকেও হার মানায়। হাওয়ায় নড়বড় করা বৃদ্ধা শহিদার ঘরটিতে রয়েছে আগুন লাগার ঝুঁকি, রয়েছে সাপ পোকা মাকড়ের ভয়। কবির আসমানী, তার পরিবারের সাথে থাকলেও কালীগঞ্জের আসমানী (শহিদা বেগম) থাকেন একাই ।
জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার খয়েরতলা গ্রামের মৃত মোহর আলীর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী শহিদা বেগম একই গ্রামের মনছের আলীর জমিতে কুড়ানো পলিথিন ও চটের ছাউনি দেয়া ঘরে একাই বসবাস করেন। দেহের হাড়গুলো প্রায় মাংসবিহীন চামড়ার সাথে মিশে গেছে। মুখে অল্প কিছু দাঁত এখনও আছে। আগুনে পুড়ে একটি হাত প্রায় অকেজো । চোখেও খুব কম দেখেন। তারপরও ভিক্ষা না করে রুগ্ন দেহ নিয়ে জীবনের চাকা ঘুরাতে বিরামহীন এগিয়ে চলা।

বৃদ্ধা শহিদা দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য হাড্ডিসার দেহ নিয়ে জীবিকার সন্ধানে প্রতি সোম ও শুক্রবার ছুটে যায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কলা হাটে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কলা চাষিরা কলার গায়ে যাতে দাগ না লাগে সেই জন্য কলা পাতা দিয়ে কাঁদিগুলো জড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করতে হাটে আসেন। কলা বিক্রির পর এলো-মেলো পড়ে থাকা পাতা কুড়িয়ে তা কলা ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেন শহিদা। কুড়ানো পাতা বিক্রি করে প্রতি হাটে ৫০ থেকে ৭০ টাকা আয় হয় তার। অনেকে খুশি হয়ে কলাও দেন। কেউ কেউ চাল-ডাল কিনে দিয়ে। তা দিয়ে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো পার হয় তার।

প্রতিবেশীরা জানায়, যৌবনে স্বাভাবিক সংসার থাকলেও স্বামী তার অমতে দ্বিতীয় বিয়ে করায় সংসারে কলহ সৃষ্টি হয়। এক পর্যয়ে রাগে ক্ষোভে দেড় বছরের শিশুসহ ৩ সন্তানকে স্বামীর ঘরে রেখে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করতেন। মন্দ ভাগ্য তার। গ্যাসের চুলার আগুনে একদিন ঝলসে যায় দেহ। যার স্বাক্ষী তার বাঁকানো পোড়া হাত। প্রায় ১৬বছর পর তিনি আবার ফিরে আসেন স্বামী ও সন্তানের টানে খয়েরতলা গ্রামে। জানতে পারেন স্বামী তাকে তালাক দিয়েছেন। সেই থেকে প্রায় দেড় যুগ ধরে জীবনের অন্তিম মুহুর্তে এসেও কলা হাটে চলছে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
সরেজমিনে বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কুড়ানো পলিথিন ও চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা স্যাঁত-সেঁতে ঘরের এক কোনায় ছোট একটি খাট। এক পাশে একটি মাটির চুলা। চুলায় আগুন জ্বালানোর সময় যে কোন সময় পুরো ঘরে আগুন লেগে যেতে পারে। আবর্জনাপূর্ণ পরিবেশে রয়েছে সাপ-পোঁকা মাকড়ের ভয়। সন্তানরা তার খোঁজ খবর নেন কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণের জন্য একদম নির্বাক হয়ে যান। পরে বলেন চার সন্তানের মধ্যে মোজাম(৪০), আফসার(৩২) ও আনোয়ারা(৩৩) নামের তিনি ছেলে মেয়ে বেঁেচ আছে। মেয়ে বেশ অসুস্থ্য। দুই ছেলে অভাবের সংসারে দিন আনে দিন খায়। তারা তাদের মতো করে একই গ্রামে থাকে। ছেলেরা মায়ের ভরন পোষণ না দিলে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিবে এ কথা বলতেই মুখ শুকিয়ে যায় শহিদার। বললেন “না তোমরা কাউকে কিছু বলো না। আমার মনিদের যাতে কিছু না হয়। সন্তানরা পাশে থেকেও নেই। অদ্ভুত এক মা। আসলে মা শব্দের মাঝেই লুকিয়ে আছে মমতা। অকৃতিম ¯েœহ আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। মা যেন সীমার মাঝে অসীম। বোঝা যায় এমন অবহেলিত বৃদ্ধা মা‘দের কথায়।

উপজেলার শ্রীরামপুরের কলা ব্যবসায়ী শুকুর আলী, নিয়ামতপুর গ্রামের মিন্টু, বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মোক্তার আলী জানান, “দীর্ঘ ১০ থেকে ১৫বছর ধরে এই কলা হাটে পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করেন তিনি। বৃদ্ধার সাথে তাদেও এক অন্য রকম সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছে। নিয়ামতপুর গ্রামের কলা ব্যবসায়ী মিন্টু প্রায় হাটেই কয়েক কেজি করে চাল কিনে দেন। বৃদ্ধার সততা তাদের মুগ্ধ করেছে বলে জানায়। সরকারী বা কোনভাবে বৃদ্ধাকে একটি থাকার ঘর ও বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য ব্যবসায়ীরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে দাবি করেন।

বৃদ্ধার ছেলে ভ্যান চালক আফসারের কাছে তার অবহেলিত মা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তার বয়স যখন ২০ থেকে ২৫ বছর তখন হঠাৎ মায়ের আগমন হয়। গ্রামের লোকজন জানায় ফিরে আসা মহিলা তার মা। তখন বাবাও বেঁচে ছিলেন। বাবা জানায় মাকে তালাক দেয়া হয়েছে বিধায় তাকে নিয়ে ঘর সংসার করা সম্ভব নয়। তোমরা তাকে নিয়ে থাকতে পার। তিনি জানান, দেড় বছর বয়সে মা আমাকে রেখে চলে যান। অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। বাবা থেকে পাওয়া মাত্র অর্ধ শতক জমিসহ অন্যের সামান্য যায়গায় ছোট একটি বাড়ি করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কোন রকম বসবাস করছেন। অন্যের জমিতে মা নিজের মত থাকলেও নিয়মিত খাবার ও কাপড় কিনে দেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে তার মিল পাওয়া যায়নি। মা‘কে কেন তাদের বাড়িতে রাখা হয়না জানতে চাইলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।

কালীগঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফাইজুর রহমান চুন্নু জানান, শহিদা বেগমকে আমি চিনি। তিনি সরকারী যেকোন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার উপযোগি। চাহিদার তুলনায় সুযোগ কম থাকায় তাকে কিছু দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে আগামীতে যে কোন দীর্ঘ মেয়াদি সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান।



No comments

Powered by Blogger.