কালীগঞ্জে বোর ধানে নতুন রোগ নেক ব্লাষ্ট, প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে মোড়ক
সাঈদুর রহমান, সংবাদদাতা ,কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
প্রান্তিক চাষী মুক্তার হোসেন। বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে। চলতি ইরি মৌসুমে পরের জমি লীজ নিয়ে ১৬ কাঠা জমিতে ব্রি-২৮ ধানের চাষ করেছিলেন। ধার দেনা করে পরিচর্যা করা ধানে শীষও বের হয়েছিল। কিন্তু গত তিন দিন আগে জমিতে গিয়ে দেখেন দু’একটা শীষের গোড়াই পচন ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তিন দিনের মাথায় জমির সব ধানের শীষ পচে শুকিয়ে চিটে হয়ে যায়। ফলে ১৬ কাঠা জমিতে এবার এক কেজি ধানও ঘরে উঠবে না তার। একই ভাবে কালীগঞ্জ উপজেলার বলরামপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন নামে এক কৃষকের ৬ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন নতুন জাতের ব্রি-৬৩ ধান। সকালে তার ধান ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায় প্রায় অর্ধেক ধানের শীষ পচে শুকিয়ে গেছে। ফলে এই দু’জাতের ধান চাষ করা কৃষকদের এবার সোনালী স্বপ্ন সর্বনাশ হতে চলেছে। তবে কালীগঞ্জ কৃষি অফিস দাবি করেছে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রনে আছে। এ পর্যন্ত ৩০ বিঘার মত ধান ছত্রাক জনিত রোগে নষ্ট হয়েছে।চলতি বছর তাদের মতো কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষকের প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ ও নতুন জাতের ব্রি-৬৩ ধানে এই ছত্রাক জনিত নেক ব্লাষ্ট রোগের মোড়ক দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা ও কৃষকরা যদি এখনি ব্যবস্থা না নিলে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি ইরি মৌসুমে উপজেলার মাঠগুলোতে ১৮ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে ইরি ধানের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ৩ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে ব্রি-২৮ এবং ১ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে নতুন জাতের ব্রি-৬৩ জাতের ধান।
কৃষকদের অভিযোগ কৃষি কর্মকর্তারা সময় মত ছত্রানাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিলে এমন ক্ষতি হত না। অনেক কৃষকের অভিযোগ তারা কৃষি কর্মকর্তাদের চেনেনই না। অন্যদিকে কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, এবার আবহাওয়া প্রতিকুল হওয়ায় আগে থেকে উপজেলার বিভিন্ন হাটে-বাজারে, মসজিদে ও লোকসমাগম স্থানে লিফলেট বিতরণ করেছি। ছত্রাক প্রতিরোধে করনিয় সম্পর্কে ব্যপক প্রচার প্রচারণা চালিয়েছি। স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিনে গুলি গুড়ি বৃষ্টি ঝড় বাতাসের কারনে ধান ক্ষেতে এই মোড়ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই রোগের ফলে ধানের শীষের গোড়ার সংযুক্ত স্থানে ছত্রাকের আক্রমনে কালচে বাদামি দাগ তৈরি হচ্ছে। ফলে ধান গাছ থেকে খাবার শীষে পৌছাতে পারছে না। যে কারনে ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। এই রোগ বাতাসের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তবে বাজারে পাওয়া যায় এমন ওষুধ ট্রপার, এমিষ্টার টপ, দিফা-৭৫ এবং ন্যাটিভো-৭৫ অনুমোদিত মাত্রায় পানির সাথে মিশিয়ে বিকালে ৫ থেকে ৭ দিনের ব্যবধানে দু’বার স্প্রে করলেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কালীগঞ্জ উপজেলার বলরামপুর গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম জানান, আমি এবছর ৬ বিঘা জমিতে ব্রি-৬৩ জাতের ধান চাষ করেছিলাম। ধান মাঠের সবার থেকে ভালো হয়েছিল। সম্প্রতি ধানের শীষ বের হওয়া শেষ হয়েছে। এখনো পাক ধরা শুরু করেছে। এরমধ্যে গত কয়েকদিন আগে মাঠে গিয়ে দেখি বেশ কিছু ধানের শীষে পচন ধরে শুকিয়ে গেছে। কিছু কিছু জমিতে অর্ধেক ধানের শীষ শুকিয়ে গেছে। এরপর কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পর নতুন করে আর পচন ধরেনি।
উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের কৃষক সুমন হোসেন জানান, চলতি বছর আমি সাড়ে চার বিঘা জমিতে ইরিধানের চাষ করেছি। এরমধ্যে ব্রি-২৮ ধান ছিল ৩ বিঘা। গত এক সপ্তাহ আগে ঝড়বাসাত ও বৃষ্টি হয়েছিল। তখন মাঠে গিয়ে দেখি ধানের শীষে পচন ধরেছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দুই দিনের মাথায় ৩ বিঘা জমিতে অর্ধেকের বেশি ধানের শীষ পচন ধরেছে। এরপর ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পর পচন রোগ আর বৃদ্ধি পায়নি।
একই গ্রামের দুদু মিয়া, তারিফ হোসেন, মুকুল সাহা ও আজহার আলীসহ সব কৃষকের ব্রি-২৮ ও ৬৩ ধানের এই মোড়ক দেখা দিয়েছে। উপজেলার বড়ঘিঘাটি গ্রামের আব্দুল মমিন জানান, ছত্রাক জনিত ব্লাষ্ট রোগে আমার প্রায় এক বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলার পাতবিলা গ্রামের রেজাউল ইসলাম জানালেন গত কয়েকদিন আগে আমার ৮ কাঠা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে কালীগঞ্জ উপজেলা সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক শফিকুর রহমান জানান, গত কয়েকদিন আগে ঝড় বাতাস হয়েছিল। পরের দিন মাঠে যেয়ে দেখি বেশ কিছু ধানের শীষে পচন রোগ দেখা দিয়েছে। আমি দেরি না করে ছত্রাকনাশক স্প্রে করার পর এখন কোন সমস্য হয়নি।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, দিনে গরম আর রাতে ঠান্ডা আবহাওয়া এই ব্লাষ্ট ছড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলার বিভিন্ন হাটে-বাজারে, মসজিদে ও লোকসমাগম স্থানে লিফলেট বিতরণ করেছি। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ছত্রাক প্রতিরোধে করনীয় সম্পর্কে ব্যপক প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে এই কর্মকর্তা দাবি করেন।
No comments